মানব শরীরের তন্ত্র

 

Science New Shyllabus-2024 Hand Note/ Goudie

নবম শ্রেণীর বিজ্ঞান-2024

2024 সালের নতুন হ্যান্ড নোট বিজ্ঞান

জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক জাতীয় শিক্ষাক্রম- ২০২২ অনুযায়ী প্রণীত এবং ২০২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে নবম শ্রেণির জন্য নির্ধারিত পাঠ্যপুস্তক বিজ্ঞান

অধ্যায় :11

মানব শরীরের তন্ত্র

অধ্যায় ১১:সালোকসংশ্লেষণ

মানব শরীরের তন্ত্র

এই অভিজ্ঞতায় শিখতে পারবে---

  • স্নায়ুতন্ত্র 
  • অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিতন্ত্র
  •  মানব শরীরের গুরুত্বপূর্ণ হরমোনসমূহ
  • হৃদ-সংবহন তন্ত্র
  • মানব দেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার পরিচয়
  • রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থার সাধারণ প্রক্রিয়া

৪.১ স্নায়ুতন্ত্র

বাইরের উদ্দীপনায় সাড়া দেয়া জীবের একটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য। মানুষের দেহের যে তন্ত্র উদ্দীপনা গ্রহণ করে এবং পরিবহন করে, উত্তেজনায় সাড়া দিয়ে জীব দেহে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটায় এবং দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অতন্ত্রগুলির শারীরবৃত্তীয় কাজের দ্রুত সংযোগ, নিয়ন্ত্রণ এবং সমন্বয় সাধনের সাহায্যে বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীন পরিবেশের পরিবর্তনের মধ্যে সমতা রক্ষায় জীব দেহের ব্যবহারিক প্রকৃতির বিকাশ ঘটায় তাকে স্নায়ুতন্ত্র বা Nervous system বলে। মানুষের এত সব কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রীয় অংশে রয়েছে মস্তিষ্ক আর ইন্দ্রিয়ের সাথে যোগাযোগ রক্ষাকারী স্নায়ুতন্ত্র। 
জীববিজ্ঞানীরা কার্যকারণ বিবেচনা করে- স্নায়ুতন্ত্রকে প্রধান দুটি ভাগে ভাগ করেছেন
 এই ভাগ দুটি হলো, 
  • কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র এবং 
  • প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্র।

৪.১.১ কেন্দ্রীয় গায়ুতন্ত্র (Central nervous system )

মস্তিষ্ক এবং মেরুমজ্জা (বা সুষুম্নাকাণ্ড) দিয়ে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র গঠিত। মস্তিষ্ক করোটিকার মধ্যে সুরক্ষিত থাকে।

মস্তিষ্ক (Brain) :

সুষুম্নাকাণ্ডের শীর্ষে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের যে স্ফীত অংশ করোটিকার মধ্যে অবস্থান করে, তাকে মস্তিষ্ক বলে। মস্তিষ্ক স্নায়ুতন্ত্রের পরিচালক। মানুষের মস্তিষ্ক শরীরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এটি শরীরের প্রতিটি অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে, শুধু তাই নয় এটি মানুষের অনুভূতি এবং চিন্তাকেও নিয়ন্ত্রণ করে। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের মস্তিষ্কের ওজন 1.4 কেজি। মস্তিষ্ক তিনটি অংশে বিভক্ত, 

  • সেরিব্রাম, 
  • স্টেম এবং 
  • সেরিব্লাম।

সেরিব্রাম:

 মস্তিষ্কের উপরের সবচেয়ে বড় অংশটিকে বলে সেরিব্রাম। সেরিব্রামের ডান ও বাম অংশ দুটি সম্পূর্ণভাবে বিভক্ত। দুটি অংশের মাঝখানে বিভেদক খাঁজ থাকায় এ বিভক্তি ঘটে। এদের সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার (Cerbral hemisphere) বলা হয়। সেরিব্রামের ডান ও বাম হেমিস্ফিয়ারের মধ্যে খাঁজ থাকলেও এ দুটি অংশ একগুচ্ছ নিউরন দিয়ে সংযুক্ত থাকে, যার নাম কর্পাস ক্যালেসাম। বাম সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার দেহের ডান অংশ এবং ডান সেরিব্রাল হেমিস্ফিয়ার দেহের বাম অংশকে নিয়ন্ত্রণ করে। এর উপরে অনেক রকম খাঁজ এবং ভাঁজ রয়েছে। এটি আমাদের চিন্তা, চেতনা, জ্ঞান, স্মৃতি, ইচ্ছা, বাকশক্তি ও ঐচ্ছিক পেশির কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। কোন উদ্দীপকের প্রতি কী ধরনের সাড়া দিবে সে সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে।

স্টেম: 

মস্তিষ্কের যে অংশটি স্পাইনাল কর্ড বাঁ সুষুম্না রজ্জুর সাথে যুক্ত থাকে তাকে স্টেম বলে। মানুষের শরীরের যা কাজগুলো নিজ থেকে হতে থাকে সেগুলো স্টেম নিয়ন্ত্রণ করে। যেমন, হৃদস্পন্দন, শ্বাস প্রশ্বাস, খুদা তৃষ্ণা, তাপমাত্ৰা ইত্যাদি।

সেরিবেলাম:

 মাথার পিছন দিকে স্টেম এবং সেরিব্রামের মাঝখানে রয়েছে সেরিবেলাম । এটি দেহের পেশির টান নিয়ন্ত্রণ, চলনে সমন্বয় সাধন, দেহের ভারসাম্য রক্ষা, দৌড়ানো এবং লাফানোর কাজে জড়িত পেশিগুলোর কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ করে। এটি মানুষের কথা বলাকেও নিয়ন্ত্রণ করে।মস্তিষ্ক থেকে বার জোড়া করোটিক স্নায়ু বের হয়ে মাথা, ঘাড়, মুখমণ্ডল, মুখগহ্বর, জিহ্বা, চোখ, নাক, কান ইত্যাদি অঞ্চলে বিস্তৃত। এর স্নায়ু খাদ্য গলাধঃকরণ, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, গলবিল ইত্যাদির কিছু কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। তাছাড়া এই স্নায়ুগুলো শ্রবণ এবং ভারসাম্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের সাথে জড়িৎ।

মেরুরজ্জু (Spinal cord):

মেরুরজ্জু করোটির পিছনে অবস্থিত ছিদ্র থেকে দিয়ে বের হয়ে মেরুদণ্ডের ভেতর দিয়ে সুরক্ষিত অবস্থায় কটিদেশ পর্যন্ত গিয়েছে। মেরুদণ্ডের হাড়ের মধ্যবর্তী ছিদ্র দিয়ে মেরুরজ্জু থেকে 31 জোড়া মেরুরজ্জীয় স্নায়ু (Spinal nerves) বের হয়। এসব ঘাড়, গলা, বুক, পিঠ, হাত ও পায়ের স্নায়ু।

৪.১.২ প্রাপ্তীয় স্নায়ুতন্ত্র (Peripheral nervous system )

মস্তিষ্ক থেকে 12 জোড়া এবং মেরুমজ্জা বা সুষুম্না কাণ্ড থেকে যে 31 জোড়া স্নায়ু বের হয়ে আসে সেগুলো সুক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর শাখায় বিভক্ত হয়ে সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে। এগুলোকে একত্রে প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্র বলে। মস্তিষ্ক থেকে উৎপন্ন করোটিক স্নায়ু চোখ, নাক, কান, জিহ্বা, দাঁত, মুখমণ্ডল, হ্রৎপিণ্ড, পাকস্থলি প্রভৃতি অঙ্গের কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। মেরুরজ্জু থেকে উদ্ভূত স্নায়ুগুলো অঙ্গ প্রত্যঙ্গ চালনা করে এবং দেহের বাকি অংশ থেকে যাবতীয় অনুভূতি মস্তিষ্কে বয়ে নিয়ে যায়। প্রান্তীয় স্নায়ুতন্ত্র সোমাটিক স্নায়ুতন্ত্র এবং স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র এই দুই ভাগে বিভক্ত।


সোমাটিক স্নায়ুতন্ত্র (Somatic Nervous System):

প্রান্তীয় স্নায়ু তন্ত্রের যেঅংশ আমাদের শরীরের অস্থিয় মাংসপেশি ব্যবহার করে নাড়াচাড়া করে তাকে সোমাটিক স্নায়ুতন্ত্র বলে। আমরা সজ্ঞানে আমাদের শরীরেরে বিভিন্ন অংশ, যেমন হাত পা কিংবা অন্য কোন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ যখন চালনা করি বা নাড়াই তখন চালনা করি বা নাড়াই তখন সোমাটিক স্নায়ুতন্ত্র সেটিকে চালনা করে। আমরা যখন হাত দিয়ে কিছু ধরতে চাই কিংবা পা দিয়ে ধাক্কা দিতে চাই তখন সোমাটিক স্নায়ুতন্ত্র হাত কিংবা পায়ের মাংস পেশীতে প্রয়োজণ্য্ সিগনাল পাঠায়।

স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র (Autonomic nervous system) :

যেসব অঙ্গের উপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই সেগুলো স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র দিয়ে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। দেহের ভিতরের অঙ্গগুলো, যেমন: 

  • হৃৎপিণ্ড
  • অস্ত্র
  • পাকস্থলি
  • অগ্ন্যাশয় 

ইত্যাদির কাজ স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র দিয়ে পরিচালিত হয়। এসব তন্ত্রের কার্যকারিতার উপর মস্তিষ্ক ও মেরুরজ্জুর প্রত্যক্ষ প্রভাব না থাকায় এরা অনেকটা স্বাধীন এবং স্বতন্ত্রভাবে আপন কর্তব্য সম্পাদন করে। এটি সিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্র এবংপ্যারাসিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্র এই দুই ভাগে বিভক্ত । হঠাৎ করে বিপজ্জনক কিংবা উত্তেজক কিছু কিছু দেখলে সিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্র সক্রিয় হয়ে আমাদের হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে তুলে, মাংসপেশি শক্ত করে তাৎক্ষণিক ভাবে কিছু একটা করার জন্য শরীরকে প্রস্তুত করে তুলে। শরীর হঠাৎ করে উত্তেজিত হওয়ার পর শরীরকে শান্ত করার জন্য প্যারাসিমপ্যাথেটিক স্নায়ুতন্ত্র কাজ করে থাকে ।

৪.১.৩ নিউরন (Neuron)

যে কলা দেহের সব ধরনের সংবেদন এবং উদ্দীপনা গ্রহণ করে এবং তা পরিবহনের মাধ্যমে উদ্দীপনা অনুসারে উপযুক্ত প্রতিবেদন সৃষ্টি করে সেটাই স্নায়ুটিস্যু বা স্নায়ুকলা। নিউরনই স্নায়ুতন্ত্রের গঠন এবং কার্যক্রমের একক। বহু সংখ্যক স্নায়ুকোষ বা নিউরনের সমন্বয়ে স্নায়ুটিস্যু গঠিত। প্রতিটি নিউরন দুটি অংশ নিয়ে গঠিত,

  • কোষদেহ এবং 
  • প্রলম্বিত অংশ।

কোষদেহ (Cell body):

প্লাজমামেমব্রেন, সাইটোপ্লাজম আর নিউক্লিয়াস নিয়ে গঠিত নিউরনের গোলাকার, তারকাকার, অথবা ডিম্বাকার অংশ কোষদেহ নামে পরিচিত। এখানে সাইটোপ্লাজমে, মাইটোকন্ড্রিয়া, গলজিবস্তু, লাইসোজোম, চর্বি, গ্লাইকোজেন, রঞ্জক কণাসহ অসংখ্য নিসল দানা থাকে।

প্রলম্বিত অংশ:

কোষদেহ থেকে সৃষ্ট শাখা প্রশাখাকেই প্রলম্বিত অংশ বলে। প্রলম্বিত অংশ দুই ধরনের:

(i) ডেনড্রান (Dendron):

কোষদেহের চারদিকের শাখাযুক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রলম্বিত অংশকে ডেনড্রন বলে। ডেনড্রন থেকে যে শাখা বের হয় তাদের ডেনড্রাইট বলে। একটি নিউরনে ডেনড্রন সংখ্যা শূন্য থেকে শতাধিক পর্যন্ত হতে পারে। এক নিউরনের ডেনড্রাইট অন্য নিউরন থেকে স্নায়ু তাড়না গ্রহণ করে।

(ii) অ্যাক্সন (Axon): 

কোষদেহ থেকে উৎপন্ন বেশ লম্বা তন্তুটির নাম অ্যাক্সন। এর চারিদিকে পাতলা আবরণটিকে নিউরেলেমা বলে। নিউরিলেমা এবং অ্যাক্সনের মধ্যবর্তী অঞ্চলে স্নেহ পদার্থের একটি স্তর থাকে। একে মায়োলিন (Myelin) বলে। অ্যাক্সনের শেষ মাথা অ্যাক্সন টারমিনালে বিভক্ত হয়ে যায়,এবং এই টারমিনালগুলো দিয়ে একটি নিউরন অন্য নিউরনের ডেনড্রাইটে স্নায়ু তাড়না প্রেরন করা হয়।একটি নিউরনের অ্যাক্সনের টারমিনালের সাথে দ্বিতীয় একটি নিউরনের ডেনড্রাইট সরাসরি যুক্ত থাকে না। এই সুক্ষ্ম ফাঁকা সংযোগস্থলকে সিন্যাপস(Synapse) বলে। 

প্রকৃতপক্ষে পর পর অবস্থিত দুটি নিউরনের সন্ধিস্থল হলো সিন্যাপস। অ্যাক্সন টারমিনাল সিন্যাপসের মধ্য দিয়ে তড়িৎ রাসায়নিক (Electro chemical) পদ্ধতিতে স্নায়ু তাড়না প্রবাহিত হয়। কোনো একটি নিউরনের মধ্য দিয়ে স্নায়ু তাড়না প্রবাহিত হয়ে সিন্যাপস অতিক্রম করে পরবর্তী নিউরনে যায়। অর্থাৎ এর ভিতর দিয়ে স্নায়ু উদ্দীপনা বা স্নায়ু তাড়না একদিকে পরিবাহিত হয়। মানুষের মস্তিষ্কে প্রায় একশত বিলিওন নিউরন রয়ছে এবং প্রতিটি নিউরন অন্য সাত থেকে দশ হাজার নিউরনের সাথে সিন্যাপস সংযোগ করে থাকে।আমরা যখন চিন্তা করি তখন এক নিউরন অন্য নিউরনের সাথে সিনন্সের মাধ্যমে সংযোগ করে, কাজেই তুমি যদি একটি বই পড়, কিংবা একটা সমস্যার সমাধান কর তাহলে নূতন সিনান্সের কারণে তুমি নিজেকে একটি পরিবর্তিত মানুষ হিসেবে ধরে নিতে পার।

উদ্দীপনা সঞ্চালন (Transmission of Impulse)

পরস্পর সংযুক্ত অসংখ্য নিউরন তন্তুর ভিতর দিয়ে উদ্দীপনা বা তাড়না শেষ পর্যন্ত মস্তিষ্কে পৌঁছায়। প্রতি সেকেন্ডে এর বেগ প্রায় 100 মিটার তবে স্নায়ুর ধরণভেদে এর তারতম্য হতে পারে। পরিবেশ থেকে যে সংকেত স্নায়ুর ভিতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছে তাকে স্নায়ু তাড়না বা উদ্দীপনা বলে। নিউরনের কার্যকারিতার ফলে উদ্দীপনা প্রয়োজনীয় অঙ্গগুলোতে সঞ্চালিত হয়। এটি মাংসপেশিতে সঞ্চালিত হলে পেশি সংকুচিত হয়ে সাড়া দেয়। ফলে প্রয়োজন মতো দেহের বিভিন্ন অঙ্গ সঞ্চালিত হয়। এই তাড়না গ্রন্থিতে পৌঁছালে সেখানে রস ক্ষরিত হয়। অনুভূতিবাহী স্নায়ু উত্তেজিত হলে সেই উত্তেজনা মস্তিষ্কের দিকে অগ্রসর হয়ে যন্ত্রণাবোধ, স্পর্শজ্ঞান, দর্শন এধরনের অনুভূতি উপলব্ধি করায়।

একটি টর্চ লাইট দিয়ে তোমার বন্ধুর চোখে আলো ফেল। লক্ষ করে দেখ, আলো ফেলার সঙ্গে সঙ্গে চোখের তারা ছোট হয়ে গেল। কেন এমন হলো?

উদ্দীপনার আকস্মিকতায় আলোর উদ্দীপনাজনিত তাড়না রেটিনা থেকে মস্তিস্কে পৌঁছালে এর নির্দেশে আইরিশের বৃত্তাকার বা গোলাকার পেশি সংকুচিত হয়। ফলে চোখের তারা ছোট হয়ে যায়।

৪.১.৪ প্রতিবর্তী ক্রিয়া (Reflex action)

প্রতিবর্তী ক্রিয়া বলতে উদ্দীপনার আকস্মিকতা এবং তার কারনে স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়াকে বোঝায়। হঠাৎ করে আঙ্গুলে সুঁচ ফুটলে অথবা হাতে গরম কিছু পড়লে আমরা অতি দ্রুত হাতটি উদ্দীপনার স্থান থেকে সরিয়ে নেই, এটি প্রতিবর্তী ক্রিয়ার ফল। আমরা চাইলেও প্রতিবর্তী ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। প্রতিবর্তী ক্রিয়া মূলত সুষুম্না কাণ্ড দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়, মস্তিষ্ক দিয়ে নয়। 

অর্থাৎ যেসব উদ্দীপনার প্রতিক্রিয়া মস্তিষ্ক দিয়ে না হয়ে সুষুম্না কাণ্ড দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয় তাকে প্রতিবর্তী ক্রিয়া বলে।

 অসতর্কভাবে সেলাই করার সময় আঙ্গুলে সুঁচ ফুটলে তাৎক্ষণিকভাবে হাত অন্যত্র সরে যাওয়ার প্রতিবর্তী ক্রিয়াটি এভাবে ব্যাখ্যা করা যায়:

  • আঙ্গুলে সুঁচ ফুটার সময় আঙ্গুলের ত্বকে অবস্থিত সংবেদী নিউরন ব্যথার উদ্দীপনা গ্রহণ করে। এখানে ত্বক গ্রাহক অঙ্গ হিসেবে কাজ করে।
  • আঙ্গুলের ত্বক থেকে এ উদ্দীপনা সংবেদী নিউরনের অ্যাক্সনের মাধ্যমে স্নায়ুকাণ্ডের ধূসর অংশে পৌঁছায়।
  • স্নায়ুকাণ্ডের ধূসর অংশে অবস্থিত সংবেদী নিউরনের অ্যাক্সন থেকে তড়িৎ রাসায়নিক পদ্ধতিতে উদ্দীপনা মধ্যবর্তী বা রিলে নিউরনের মাধ্যমে 
  • মোটর বা আজ্ঞাবাহী স্নায়ু কোষের ডেনড্রাইটে প্রবেশ করে।
  • অজ্ঞাবাহী স্নায়ুর অ্যাক্সনের মাধ্যমে এ উদ্দীপনা পেশিতে প্রবেশ করে।
  • উদ্দীপনা পেশিতে পৌঁছালে পেশির সংকোচন ঘটে। ফলে উদ্দীপনাস্থল থেকে হাত দ্রুত আপনা আপনি সরে যায়।

৪.১.৫ স্নায়বিক বৈকল্যজনিত কয়েকটি শারীরিক সমস্যা

(a) প্যারালাইসিস (Pralysis): 

শরীরের কোনো অংশের ঐচ্ছিক মাংসপেশি ইচ্ছামত নাড়াতে পারার ক্ষমতা নষ্ট হওয়াকে প্যারালাইসিস বলে। সাধারণত মস্তিষ্কের কোনো অংশের ক্ষতির কারণে ঐ অংশের সংবেদন গ্রহণকারী পেশিগুলো কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলে। অনেক সময় স্ট্রোকের কারণে প্যারালাইসিস হয়ে থাকে। এছাড়া মেরুদণ্ডের বা ঘাড়ের সুষুম্নাকাণ্ড আঘাত বা দুর্ঘটনাজনিত কারণেও প্যারালাইসিস হতে পারে।

(b) এপিলেপসি (Epilepsy):

 এপিলেপসি বা মৃগী রোগ মস্তিষ্কের একটি রোগ যাতে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে খিঁচুনি বা কাঁপুনি দিতে থাকে ।অনেকক্ষেত্রে রোগী অজ্ঞান হয়ে পড়ে। অনেকক্ষেত্রে এই রোগের কারণে আক্রান্ত ব্যক্তি হঠাৎ করেই সাময়িকভাবে কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, শরীর কাঁপুনি ও খিঁচুনি দিতে দিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। এপিলেপসির মূল কারণ এখনও সম্পূর্ণভাবে জানা যায়নি। মাথায় আঘাতজনিত কারণে ম্যানিনজাইটিস, এনসেফালাইটিস, জন্মগত মস্তিষ্কের বিকৃতি, টিউমার ইত্যাদি কারণেও এপিলেপসির উপসর্গ দেখা দেয়।

(c) পারকিনসন রোগ (Parkinson's disease):

 পারকিনসন রোগ মস্তিষ্কের এমন এক অবস্থা যেখানে হাতে ও পায়ের কাঁপুনি হয়এবং আক্রান্ত রোগীর নড়াচড়া, হাঁটাহাটি করতে সমস্যা হয়। এ রোগ সাধারণত 50 বছরের বয়সের পরে হয়। স্নায়ু কোষ বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে থাকে, যার একটি হল ডোপামিন। ডোপামিন শরীরের পেশির নড়াচড়ায় সাহায্য করে। পারকিনসন রোগাক্রান্ত রোগীর মস্তিষ্কে ডোপামিন তৈরির কোষগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। ডোপামিন ছাড়া ঐ স্নায়ু কোষগুলো পেশি কোষগুলোতে সংবেদন পাঠাতে পারে না। ফলে মাংসপেশি তার কার্যকারিতা হারায়।

1.2 ৪.২ অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিতন্ত্র:

মানুষ এবং বিভিন্ন প্রাণীর দেহে একধরনের বিশেষ নালিবিহীন গ্রন্থি থাকে। এসব গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত রস রক্তের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে দেহের বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। নালিবিহীন গ্রন্থি নিঃসৃত এ ধরনের রসকে হরমোন বলে। হরমোন পরিবহনের জন্য পৃথক কোনো নালি নেই। হরমোন রক্তস্রোতের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে নির্দিষ্ট লক্ষ্যকোষে পৌঁছে কোষের প্রাণরাসায়নিক কার্যকলাপকে প্রভাবিত করে, জৈবিক কার্যাবলি সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করে। সুস্থ দেহের চাহিদা অনুসারে গ্রন্থি থেকে অবিরত ধারায় হরমোন নিঃসৃত হয়। তবে প্রয়োজন অপেক্ষা কম অথবা বেশি পরিমাণ হরমোন নিঃসৃত হলে শরীরে নানারকম অবাঞ্ছিত প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়।

৪.২.১ মানবদেহের কয়েকটি মুখ্য নালিবিহীন গ্রন্থির পরিচিতি, কাজ ও নিঃসৃত হরমোন

(a) পিটুইটারি গ্রন্থি (Pitutary gland):

মানবদেহের সবচেয়ে ছোট এই গ্রন্থিটি মস্তিষ্কের নিচের অংশে অবস্থিত। পিটুইটারি গ্রন্থি মানবদেহের প্রধান হরমোন উৎপাদনকারী গ্রন্থি। একদিকে পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন সংখ্যায় যেমন বেশি, অপরদিকে অন্যান্য গ্রন্থির উপর এসব হরমোনের প্রভাবও বেশি। এটি অন্যান্য গ্রন্থিকে প্রভাবিত করা ছাড়াও মানব দেহের বৃদ্ধির হরমোন নির্গত করে ।

(b) থাইরয়েড গ্রন্থি (Thyrioid gland): 

থাইরয়েড গ্রন্থি গলায় ট্রাকিয়ার উপরের অংশে অবস্থিত। এই গ্রন্থি থেকে প্রধানত থাইরক্সিন হরমোন নিঃসরণ হয়। থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন থাইরক্সিন ( Thyroxin) সাধারণত মানবদেহে স্বাভাবিক বৃদ্ধি, বিপাকীয় কাজ নিয়ন্ত্রণ করে। থাইরয়েডের আরেকটি হরমোন মানবদেহে ক্যালসিয়াম বিপাকের সাথে জড়িত।

(c) প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি (Parathyroid gland): 

একজন মানুষের সাধারণত চারটি প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি থাকে যার সবগুলোই থাইরয়েড গ্রন্থির পিছনে অবস্থিত। এই গ্রন্থি হতে নিঃসৃত হরমোন মূলত ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাসের বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে।

(d) থাইমাস গ্রন্থি (Thymus gland): 

থাইমাস গ্রন্থি গ্রীবা অঞ্চলে অবস্থিত। থাইমাস গ্রন্থি দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বিকাশে সাহায্য করে। শিশুকালে এই গ্রন্থি বিকশিত থাকে পরে বয়োবৃদ্ধির সাথে সাথে ছোট হয়ে যায়। পূর্ণবয়স্ক মানুষে সাধারণত এই হরমোন থাকে না, থাকলেও খুবই নিম্ন মাত্রায়। রোগ প্রতিরোধ বিকাশে এ গ্রন্থি গুরুত্বপূর্ণ। এ গ্রন্থি বেশ কয়েকটি হরমোন তৈরি করে যা থাইমাসে শ্বেতকণিকা তৈরিতে ভূমিকা রাখে।

(e) অ্যাডরেনাল বা সুপ্রারেনাল গ্রন্থি (Adrenal gland):

অ্যাডরেনাল গ্রন্থি কিডনির উপরে অবস্থিত। অ্যাডরেনাল গ্রন্থি দেহের অত্যাবশ্যকীয় বিপাকীয় কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। এই গ্রন্থি মূলত কঠিন মানসিক ও শারীরিক চাপ থেকে পরিত্রাণে সাহায্য করে। অ্যাডরেনালিন (adrenalin) এই গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোনগুলোর একটি। অ্যাডরেনালিন হরমোন হৃৎপিণ্ড ও ধমনির অনৈচ্ছিক পেশির সংকোচন নিয়ন্ত্রণ করে ভয়, আনন্দ ও শোক প্রকাশে বিশেষ ভুমিকা পালন করে।

(f) আইলেটস অফ ল্যাংগারহ্যানস (Islets of langerhans): 

আইলেটস্ অফ ল্যাংগারহ্যানস অগ্ন্যাশয়ের মাঝে অবস্থিত, এই কোষগুচ্ছ শরীরের শর্করা বিপাক নিয়ন্ত্রণ করে। এর নালিহীন কোষগুলো ইনসুলিন (insulin) নিঃসরণ করে যা রক্তের গ্লুকোজের মাত্রানিয়ন্ত্রণ করে। যেহেতু ইনসুলিন দেহের শর্করা পরিপাক নিয়ন্ত্রণ করে, তাই অগ্ন্যাশয়ে যদি প্রয়োজনমতো ইনসুলিন তৈরি না হয় তবে রক্তে শর্করার পরিমাণ স্থায়ীভাবে বেড়ে যায়।

(g) গোনাড বা জনন অঙ্গ গ্রন্থি: 

এটি মেয়েদের ডিম্বাশয় এবং ছেলেদের শুক্রাশয়ে অবস্থিত। জনন অঙ্গ থেকে নিঃসৃত হরমোন দেহের পরিণত বয়সের লক্ষণগুলো বিকশিত করতে ভূমিকা রাখে। এছাড়াও প্রাণীর জনন অঙ্গের বৃদ্ধির পাশাপাশি জননচক্র এবং যৌন আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। জনন অঙ্গ থেকে পরিণত বয়সের পুরুষ-দেহে টেস্টোস্টেরন (testosterone) এবং স্ত্রী-দেহে ইস্ট্রোজেন (estrogens) নামক হরমোন উৎপন্ন হয়।

৪.২.২ হরমোনজনিত কয়েকটি অস্বভাবিকতা

(a) থাইরয়েড সমস্যা:

 আয়োডিনযুক্ত খাবার খেলে থাইরয়েড হরমোন তৈরি হয়। সমুদ্রের পানিতে আয়োডিন থাকায় সামুদ্রিক মাছ মানুষের খাদ্যে আয়োডিনের অন্যতম মূল উৎস। আয়োডিনের অভাবে গলগণ্ড বা গয়টার রোগ হয়ে থাকে, তাই সমুদ্র থেকে দূরে অবস্থিত এলাকায় একসময় এই রোগীর সংখ্যা বেশি পাওয়া যেতো। খাদ্যে আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহারের কারণে আজকাল এই রোগের প্রাদুর্ভাব দূর করা সম্ভব হয়েছে। গলগণ্ড ছাড়া থাইরয়েড হরমোনের ঘাটতি হলে শিশুদের মানসিক বিকাশও বাধা পায় এবং চেহারায় স্বাভাবিক শিশুদের থেকে বৈসাদৃশ্য থাকে, সামুদ্রিক মাছ ছাড়া কলা, ফলমূল, কচু ইত্যাদি খেলে এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

(b) বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস (Diabetes): 

অগ্ন্যাশয়ে যদি প্রয়োজনমতো ইনসুলিন তৈরি না হয় তবে রক্তে দেহের শর্করা পরিপাক নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না বলে দেহে শর্করার পরিমাণ স্থায়ীভাবে বেড়ে যায় যে অবস্থাকে বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস বলে। ডায়াবেটিস প্রধানত দুই ধরনের, টাইপ-1 এবং টাইপ-2। টাইপ-1 এ আক্রান্ত রোগীর দেহে একেবারেই ইনসুলিন তৈরি হয় না। তাই নিয়মিত ভাবে ইনজেকশনের মাধ্যমে ইনসুলিন নিতে হয়। অন্যদিকে টাইপ-2 রোগীর দেহে আংশিকভাবে ইনসুলিন তৈরি হয়। এক্ষেত্রে ঔষধ, অগ্ন্যাশয় কোষকে শরীরের জন্য পরিমিত ইনসুলিন তৈরিতে সাহায্য করে। একজন ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য তার সুশৃঙ্খল জীবন ব্যবস্থা, পরিমিত খাদ্য গ্রহণ এবং নিয়মিত ব্যায়াম দিয়ে অনেক সময় এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়।

৪.৩ মানব শরীরের গুরুত্বপূর্ণ হরমোনসমূহ

মানব দেহে অনেক ধরণের হরমোন কার্যকর রয়েছে, তার ভেতরে অর্ধশতাধিক হরমোন বিজ্ঞানীরা গুরুত্বপুর্ণ হরমোন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এদের ভেতর থেকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ হরমোনের নাম, তাদের কাজ এবং সেটি কোন গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত হয় এটি নিচে দেওয়া হল:

১. ইনসুলিন: 

রক্তের গ্লুকোজ দেহকোষে পেরন করে রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ করে; এটি অগ্ন্যাশয়ের আইলেটস্ অফ ল্যাংগারহ্যানস উৎপন্ন হয়।

২. থাইরয়েড হরমোন বা থাইরোক্সিন:

 দেহের বিপাক এবং শক্তি উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করে; থাইরয়েড গ্রন্থিতে উৎপাদিত।

৩. কর্টিসোল:

 মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ, শরীরের বৃদ্ধি, এবং ইমিউন কার্যক্রম পরিচালনা করে; এড্রেনাল গ্রন্থি থেকে উৎপন্ন।

৪. অ্যাড্রেনালিন: 

কঠিন মানসিক ও শারীরিক চাপের জন্য প্রস্তুত করে; এড্রেনাল গ্রন্থি দ্বারা উৎপন্ন।

৫. টেস্টোস্টেরোন: 

পুরুষের জনন অঙ্গের বৃদ্ধির পাশাপাশি জননচক্র এবং যৌন আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। পুরুষের শুক্রাশয়ে উৎপন্ন হয়।

৬. এস্ট্রোজেন: 

মেয়েদের জনন অঙ্গের বৃদ্ধির পাশাপাশি জননচক্র এবং যৌন আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। মেয়েদের ডিম্বাশয় উৎপন্ন হয়।

৭. প্রোজেস্টেরোন: 

সন্তান জন্মের জন্য গর্ভাশয়কে প্রস্তুত করে এবং গর্ভকাঈন সময়ে সহায়তা করে; মেয়েদের ডিম্বাশয়, বিশেষভাবে কর্পাস লুটিয়ামে উৎপন্ন হয়।

৮. গ্রোথ হরমোন: 

দৈহিক বৃদ্ধি, কোষ বিভাজনে সহায়তা করে; পিটুইটারি গ্রন্থি দ্বারা উৎপন্ন।

৯. মেলাটনিন: 

ঘুম-জাগরণ চক্র এবং দিন-রাত অনুভূতি নিন্ত্রণ করে ;পাইনিয়াল গ্রন্থি দ্বারা উৎপন্ন।

১০. অক্সিটোসিন (পিটোসিন) : 

সামাজিক বন্ধন উৎসাহিত করে, প্রসবে সহায়তা করে এবং মাতৃদুগ্ধ নির্গমনে সহায়তা করে; হাইপোথালামাস দ্বারা উৎপন্ন এবং পিটুইটারি গ্রন্থি দ্বারা মুক্ত।

৪.৩ হৃদ-সংবহন তন্ত্র (Blood Circulation):

রক্ত জীবনীশক্তির মূল। রক্তনালির মধ্য দিয়ে রক্ত দেহের সর্বত্র প্রবাহিত হয় ও কোষে অক্সিজেন এবং খাদ্য উপাদান সরবরাহ করে। ফলে দেহের সব কোষ সজীব এবং সক্রিয় থাকে। যে তন্ত্রের মাধ্যমে রক্ত প্রতিনিয়ত দেহের বিভিন্ন অঙ্গ এবং অংশে চলাচল করে তাকে রক্ত সংবহনতন্ত্র বলে। এ তন্ত্রে প্রবাহিত রক্তের মাধ্যমেই খাদ্য, অক্সিজেন এবং রক্তের বর্জ্য পদার্থ দেহের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পরিবাহিত হয়।মানবদেহে রক্তপ্রবাহ কেবল হৃৎপিণ্ড এবং রক্তনালিগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, কখনও এর বাইরে আসে না। এ ধরনের সংবহনতন্ত্রকে বন্ধ সংবহনতন্ত্র (Close circulatory system) বলা হয়। সারাদেহে রক্ত একবার সম্পূর্ণ পরিভ্রমণের জন্য মাত্র এক মিনিট বা তার চেয়েও কম সময় লাগে। বদ্ধ সংবহনতন্ত্রের বড় সুবিধা হলো এ ব্যবস্থায়,

  • (a) রক্ত সরাসরি দেহের বিভিন্ন অঙ্গে গিয়ে পৌঁছে,
  • (b) রক্তবাহী নালির ব্যাসের পরিবর্তনের মাধ্যমে দেহ কোনো বিশেষ অঙ্গে রক্ত প্রবাহের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে,
  • (c) রক্ত বিভিন্ন অঙ্গে পরিভ্রমণ করে দ্রুত হৃৎপিণ্ডে ফিরে আসে। অন্যান্য তন্ত্রের তুলনায় রক্ত সংবহনতন্ত্র বিশেষ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ হলেও এর গঠনশৈলী মোটামুটি সাধারণ।

৪.৩.১ রক্ত (Blood)

রক্ত একটি অস্বচ্ছ, মৃদু ক্ষারীয় এবং লবণাক্ত তরল পদার্থ। রক্ত হৃৎপিণ্ড, শিরা, উপশিরা, ধমনি, শাখা ধমনি এবং কৈশিকনালি পথে আবর্তিত হয়। লোহিত রক্তকণিকায় হিমোগ্লোবিন নামক রঞ্জক পদার্থ থাকার কারণে রক্তের রং লাল দেখায়। হাড়ের লাল অস্থিমজ্জাতে রক্তকণিকার জন্ম হয়।

রক্তের উপাদান

রক্ত এক ধরনের তরল যোজক কলা। রক্তরস এবং কয়েক ধরনের রক্তকণিকার সমন্বয়ে রক্ত গঠিত।

(a) রক্তরস (Plasma):

রক্তের বর্ণহীন তরল অংশকে রক্তরস বলে। সাধারণত রক্তের শতকরা প্রায় 55 ভাগ রক্তরস । রক্তরসের প্রধান উপাদান পানি। এছাড়া বাকি অংশে কিছু প্রোটিন, জৈবযৌগ ও সামান্য অজৈব লবণ দ্রবীভূত অবস্থায় থাকে। এর মধ্যে যে পদার্থগুলো থাকে সেগুলো হচ্ছে: প্রোটিন, গ্লুকোজ, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চর্বিকণা, খনিজ লবণ, ভিটামিন, হরমোন, এন্টিবডি এবং কার্বন ডাই- অক্সাইড, ইউরিয়া, ইউরিক এসিড ইত্যাদি বর্জ্যপদার্থ । আমরা খাদ্য হিসেবে যা গ্রহণ করি তা পরিপাক হয়ে অস্ত্রের গাত্রে শোষিত হয় এবং রক্তরসে মিশে দেহের সর্বত্র সঞ্চালিত হয়। এভাবে দেহকোষগুলো পুষ্টিকর দ্রব্যাদি গ্রহন করে দেহের পুষ্টি সাধন এবং ক্ষয়পূরণ করে।

(b) রক্তকণিকা (Blood corpuscles )

মানবদেহে তিন ধরনের রক্তকণিকা দেখা যায়, 

  • লোহিত রক্তকণিকা (Red Blood Corpuscles), 
  • শ্বেত রক্তকণিকা (White Blood Corpuscles) এবং 
  • অণুচক্রিকা (Blood Platelets)

যদিও এগুলো সব কোষ, তবে রক্তের প্লাজমার মধ্যে ভাসমান কণার সাথে তুলনা করে এদেরকে অনেকদিন আগে রক্তকণিকা নাম দেওয়া হয়েছিল, সেই নাম এখনও প্রচলিত।

(a) লোহিত রক্তকণিকা: 

মানবদেহে তিন ধরনের রক্তকণিকার মধ্যে লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। এটি শ্বাসকার্যে অক্সিজেন পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। লাল অস্থিমজ্জায় লোহিত রক্তকণিকা তৈরি হয়। এর গড় আয়ু 120 দিন। মানুষের লোহিত রক্তকণিকায় নিউক্লিয়াস থাকে না, এবং দেখতে অনেকটা দ্বি-অবতল বৃত্তের মতো। পূর্ণবয়স্ক ব্যক্তির রক্তে লোহিত রক্তকণিকার সংখ্যা প্রতি কিউবিক মিলিমিটারেপ্রায় 50 লক্ষ। এটি শ্বেত রক্তকণিকার চেয়ে প্রায় 500 গুণ বেশি। পুরুষের তুলনায় মহিলাদের রক্তে লোহিত রক্তকণিকা কম থাকে। তুলনামূলকভাবে শিশুদের দেহে লোহিত রক্তকণিকার পরিমাণ বেশি থাকে। আমাদের জীবনের প্রতি মূহূর্তে লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস হয়, আবার সমপরিমাণে তৈরিও হয়। লোহিত রক্তকণিকার হিমোগ্লোবিন অক্সিজেন পরিবহন করে।

হিমোগ্লোবিন:

হিমোগ্লোবিন এক ধনের রঞ্জক পদার্থ। লোহিত রক্তকণিকায় এর উপস্থিতির কারণে রক্ত লাল দেখায়। রক্তে উপযুক্ত পরিমাণ হিমোগ্লোবিন না থাকলে রক্তস্বল্পতা বা রক্তশুন্যতা (anemia) দেখা দেয়। বাংলাদেশের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী এ রোগে আক্রান্ত ।

(b) শ্বেত রক্তকণিকা বা লিউকোসাইট:

 শ্বেত কণিকার নির্দিষ্ট কোনো আকার নেই। এগুলো হিমোগ্লোবিনবিহীন এবং নিউক্লিয়াসযুক্ত বড় আকারের কোষ। শ্বেত রক্ত কণিকায় DNA থাকে। শ্বেত কণিকার গড় আয়ু ১-১৫ দিন। হিমোগ্লোবিন না থাকার কারণে এদের শ্বেত রক্তকণিকা, ইংরেজিতে White Blood Cell বা WBC বলে। শ্বেত কণিকার সংখ্যা RBC এর তুলনায় অনেক কম। এরা অ্যামিবার মতো দেহের আকারের পরিবর্তন করে। ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় (চিত্র ৩.০৩) এটি জীবাণুকে ধ্বংস করে।শ্বেত কণিকাগুলো রক্তরসের মধ্য দিয়ে নিজেরাই চলতে পারে। রক্ত জালিকার প্রাচীর ভেদ করে টিস্যুর মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। দেহ বাইরের জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হলে, দ্রুত শ্বেত কণিকার সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটে। মানবদেহে প্রতি ঘনমিলিমিটার রক্তে ৪-১০ হাজার শ্বেত রক্তকণিকা থাকে। অসুস্থ মানবদেহে এর সংখ্যা বেড়ে যায়।

(c) অণুচক্রিকা বা থ্রম্বোসাইট:

ইংরেজিতে এদেরকে প্লেইটলেট (Platelet) বলে। এগুলো গোলাকার, ডিম্বাকার অথবা রড আকারের হতে পারে। এদের সাইটোপ্লাজম দানাদার এবং সাইটোপ্লাজমে কোষ অঙ্গানু- মাইটোকন্ড্রিয়া, গল্পি বস্তু থাকে; কিন্তু নিউক্লিয়াস থাকেনা। অনুচক্রিকাগুলোর গড় আয়ু ৫-১০ দিন। পরিণত মানবদেহে প্রতি ঘনমিলিমিটার রক্তে অণুচক্রিকার সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। অনুচক্রিকার প্রধান কাজ হলো রক্ত জমাট বাধানোতে (blood clotting) সাহায্য করা। যখন কোনো রক্তবাহিকা বা কোনো টিস্যু আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে কেটে যায়, তখন সেখানকার অনুচক্রিকাগুলো সক্রিয় হয়ে উঠে অনিয়মিত আকার ধারণ করে (চিত্র ৩.০৫) এবং ক্ষত স্থানে রক্তকে জমাট বাধাতে সাহায্য করে রক্তক্ষরণ বন্ধ করে। রক্তে উপযুক্ত পরিমাণ অণুচক্রিকা না থাকলে রক্তপাত সহজে বন্ধ হয় না।



রক্তের কাজ :

রক্ত দেহের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি দেহের নানাবিধ কাজ করে, যেমন:

  • (a) অক্সিজেন পরিবহন: লোহিত রক্তকণিকা কোষে অক্সিজেন পরিবহন করে।
  • (b) কার্বন ডাইঅক্সাইড অপসারণ: রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে কোষগুলোতে যে কার্বন ডাইঅক্সাইড উৎপন্ন হয় তা রক্তরস এবং লোহিত রক্তকণিকার সমন্বয়ে সংগ্রহ করে নিয়ে আসে এবং নিঃশ্বাস বায়ুর সাথে ফসুফুসের সাহায্যে দেহের বাইরে বের করে দেয়।
  • (c) খাদ্যসার পরিবহন: রক্তরস গ্লুকোজ, অ্যামাইনো এসিড, চর্বিকণা ইত্যাদি কোষে সরবরাহ করে।
  • (d) তাপের সমতা রক্ষা: দেহের মধ্যে অনবরত দহনক্রিয়া সম্পাদিত হচ্ছে। এতে করে বিভিন্ন অঙ্গে বিভিন্ন মাত্রার তাপ সৃষ্টি হয় এবং তা রক্তের 
  • মাধ্যমে দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এভাবে দেহের সর্বত্র তাপের সমতা রক্ষা হয়।
  • (e) বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশন: রক্ত দেহের জন্য ক্ষতিকর বর্জ্য পদার্থ বহন করে এবং বিভিন্ন অঙ্গের মাধ্যমে সেসব ইউরিয়া, ইউরিক এসিড ও কার্বন
  •  ডাইঅক্সাইড হিসেবে নিষ্কাশন করে।
  • (f) হরমোন পরিবহন: হরমোন সরাসরি রক্তে মিশে প্রয়োজন অনুযায়ী বিভিন্ন অঙ্গে সঞ্চালিত হয় এবং বিভিন্ন জৈবিক কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা 
  • পালন করে।
  • (g) রোগ প্রতিরোধ: কয়েক প্রকারের শ্বেত রক্তকণিকা ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় দেহকে জীবাণুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। এন্টিবডি ও 
  • এন্টিজেন উৎপাদনের মাধ্যমে রক্ত দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
  • (h) রক্ত জমাট বাঁধা: দেহের কোনো অংশ কেটে গেলে অণুচক্রিকা রক্ত জমাট বাঁধতে সাহায্য করে এবং দেহের রক্তক্ষরণ বন্ধ করে।

৪.৩.৩ রক্তনালি (Blood vessel):

যেসব নালির ভিতর দিয়ে রক্ত প্রবাহিত বা সঞ্চালিত হয় তাকে রক্তনালি বলে। এসব নালিপথে হৃৎপিণ্ড থেকে দেহের বিভিন্ন অংশে রক্ত বাহিত হয় এবং দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে পুনরায় হৃৎপিণ্ডে ফিরে আসে। গঠন, আকৃতি এবং কাজের ভিত্তিতে রক্তবাহিকা বা রক্তনালি তিন ধরনের,

  •  ধমনি,
  •  শিরা এবং
  •  কৈশিক জালিকা।


(a) ধমনি (Artery):

 যেসব রক্তনালির মাধ্যমে হৃৎপিণ্ড থেকে সারাদেহে বাহিত হয় তাকে ধমনি বলে। ফুসফুসীয় ধমনি ছাড়া অন্য সব ধমনীর রক্ত সাধারণত অক্সিজেনসমৃদ্ধ। ফুসফুসীয় ধমনির বেলায় হৃৎপিন্ড থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইডযুক্ত রক্ত এই ধমনী দিয়ে ফুসফুসে যায়।ধমনির প্রাচীর গুরু ও স্থিতিস্থাপক। ধমনিতে কপাটিকা থাকে না, এর নালিপথ সরু। হৃৎপিণ্ডের প্রত্যেক সংকোচনের ফলে দেহে ছোট বড় সব ধমনিতে রক্ত তরঙ্গের মতো প্রবাহিত হয়। এতে ধমনিগাত্র সংকুচিত বা প্রসারিত হয়। ধমনির এই স্ফীতি এবং সংকোচনকে নাড়িস্পন্দন বলে। ধমনিরভিতর রক্ত প্রবাহ, ধমনিগাত্রের সংকোচন, প্রসারণ এবং স্থিতিস্থাপকতা নাড়িস্পন্দনের প্রধান কারণ। হাতের কব্জির ধমনির উপর হাত রেখে নাড়িস্পন্দন অনুভব করা যায়।

(b) শিরা (Vein):

যেসব নালি দিয়ে রক্ত দেহের বিভিন্ন অংশ থেকে হৃৎপিণ্ডে ফিরে আসে তাদের শিরা বলে। এরা ধমনির মতোই সারা দেহে ছড়িয়ে থাকে। শিরাগুলো সাধারণত দেহের বিভিন্ন স্থানের কৈশিকনালি থেকে আরম্ভ হয় এবং এ রকম অসংখ্য নালি একত্রে সূক্ষ্ম শিরা, উপশিরা, অতঃপর শিরা এবং মহাশিরায় পরিণত হয়ে হৃৎপিণ্ডে ফিরে আসে। শিরার প্রাচীর ধমনির মতো তিন স্তরবিশিষ্ট। শিরার প্রাচীর কম পুরু, কম স্থিতিস্থাপক ও কম পেশিময়। এদের নালিপথ একটুচওড়া এবং শিরাকে কপাটিকা থাকে। ফুসফুস থেকে হৃৎপিণ্ডে আসা শিরাটি ছাড়া অন্য সব শিরা কার্বন ডাইঅক্সাইডসমৃদ্ধ রক্ত পরিবহন করে হৃৎপিণ্ডে নিয়ে আসে। ফুসফুসীয় শিরা অক্সিজেন সমৃদ্ধ রক্ত ফুসফুস থেকে হৃৎপিন্ডে পৌঁছে দেয়।

(c) কৈশিক জালিকা (Capillaries)

পেশিতন্ত্রতে চুলের মতো অতি সূক্ষ্ম রক্তনালি দেখা যায়। একে কৈশিক জালিকা বা কৈশিক নালি বলে। এগুলো একদিকে ক্ষুদ্রতম ধমনি এবং অন্যদিকে ক্ষুদ্রতম শিরার মধ্যে সংযোগ সাধন করে। ফলে ধমনি শাখা-প্রশাখায় বিভক্ত হয়ে ক্রমে ক্রমে সূক্ষ্ম হতে সূক্ষ্মতর কৈশিক নালিতে পরিণত হয় এবং প্রত্যেকটি কোষকে পরিবষ্টেন করে রাখে। এদের প্রাচীর অত্যন্ত পাতলা। এই পাতলা প্রাচীর ভেদ করে রক্তে দ্রবীভূত সব বস্তু ব্যাপন প্রক্রিয়ায় কোষে প্রবেশ করে।

৪.৩.২ হৃৎপিণ্ডের গঠন ও কাজ

হৃৎপিণ্ডের গঠন

হৃৎপিণ্ড বক্ষ গহ্বরের বাম দিকে দুই ফুসফুসের মাঝখানে অবস্থিত একটি ত্রিকোণাকার ফাঁপা অঙ্গ। এটি হৃৎপেশি নামক এক বিশেষ ধরনের অনৈচ্ছিক পেশি দিয়ে গঠিত। হৃৎপিণ্ডের ভিতরের স্তর ফাঁপা এবং চারটি প্রকোষ্ঠে বিভক্ত। উপরের প্রকোষ্ঠ দুটি নিচের দুটির চেয়ে আকারে ছোট। উপরের প্রকোষ্ঠ দুটিকে ডান এবং বাম অলিন্দ (rigth & left atrium) 

এবং নিচের প্রকোষ্ঠ দুটিকে 

ডান এবং বাম নিলয় (right & left ventricle) বলে। 



হৃৎপিণ্ডের উভয় অলিন্দ এবং নিলয়ের মাঝে যে ছিদ্র পথ আছে তা খোলা বা বন্ধ করার জন্য ভালভ (valve) বা কপাটিকা থাকে। এদের অবস্থানের ফলে পাম্প করা রক্ত একই দিকে চলে এবং রক্ত উল্টো দিকে ফিরে আসতে পারে না।



হৃৎপিণ্ডের মধ্যে রক্ত সঞ্চালন পদ্ধতি

অলিন্দ দুটি প্রসারিত হলে শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্ত হৃৎপিণ্ডে প্রবেশ করে। উর্ধ্ব মহাশিরার ভেতর দিয়ে কার্বন ডাই অক্সাইড যুক্ত রক্ত ডান অলিন্দে প্রবেশ করে। ফুসফুসীয় বা পালমোনারি শিরার ভেতর দিয়ে অক্সিজেন যুক্ত রক্ত বাম অলিন্দে প্রবেশ করে।অলিন্দ দুটির সংকোচন হলে নিলয় দুটির পেশি প্রসারিত হয। তখন ডান অলিন্দ-নিলয়ের ছিদ্রপথের ট্রাইকাসপিড ভাল্ব খুলে যায় এবং ডান অলিন্দ থেকে কার্বন ডাই অক্সাইড যুক্ত রক্ত ডান নিলয়ে প্রবেশ করে। ঠিক এই সময়ে বাম অলিন্দ এবং বাম নিলয়ের বাইকাসপিড বাল্ব খুলে যায় তখন বাম অলিন্দ থেকে অক্সিজেন যুক্ত রক্ত বাম নিলয়ে প্রবেশ করে। এর পরপরই ছিদ্রগুলো কপাটিকা দিয়ে বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে নিলয় থেকে রক্ত আর অলিন্দে প্রবেশ করতে পারে না।

যখন নিলয় দুটি সংকুচিত হয় তখন ডান নিলয় থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইডযুক্ত রক্ত ফুসফুসীয় ধমনির মাধ্যমে ফুসফুসে প্রবেশ করে। এখানে রক্ত পরিশোধিত হয়। ঠিক একই সময়ে বাম নিলয় থেকে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত মহাধমনির মাধমে সারা দেহে পরিবাহিত হয় এবং উভয় ধর্মনির অর্ধচন্দ্রাকৃতির কপটিকাগুলো বন্ধ হয়ে যায়। ফলে রক্ত পুনরায় নিলয়ে ফিরে আসতে পারে না। এভাবে হৃৎপিণ্ডে পর্যায়ক্রমিক সংকোচন এবং প্রসারণের ফলে রক্ত সঞ্চালন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে।

হৃৎপিণ্ডের কাজ: 

রক্ত সংবহন তন্ত্রের প্রধান অঙ্গ হৃৎপিণ্ড। এর সাহায্যেই সংবহনতন্ত্রের রক্ত প্রবাহ সচল থাকে। হৃৎপিণ্ডের প্রকোষ্ঠগুলো সম্পূর্ণ বিভক্ত থাকায় এখানে অক্সিজেনযুক্ত ও অক্সিজেনবিহীন রক্তের সংমিশ্রণ ঘটে না।

৪.৩.৪ রক্ত সংবহনতন্ত্রের কয়েকটি রোগ

উচ্চ রক্তচাপ (High blood pressure ): 

হৃৎরোগ এবং স্ট্রোকের অন্যতম প্রধান কারণ হলো উচ্চ রক্তচাপ। রক্ত চলাচলের সময় রক্তনালি গাত্রে যে চাপ সৃষ্টি হয় তাকে রক্তচাপ বলে। আর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি রক্তচাপকে উচ্চ রক্তচাপ বলা হয়। একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রে সাধারণত সিস্টোলিক চাপ 120 মিলিমিটার পারদ এর নিচে এবং ডায়াস্টলিক চাপ ৪০ মিলিমিটার পারদ এর নিচের মাত্রাকে কাংখিত মাত্রা হিসেবে ধরা হয়। আর এই রক্তচাপ যখন মাত্রাতিরিক্ত হয় তখনই আমরা তাকে উচ্চ রক্তচাপ বলে থাকি।

হার্ট অ্যাটাক:

 যখন কারও হৃত্যন্ত্রের কোনো অংশে রক্ত জমাট বাঁধার কারণে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় কিংবা বাধাগ্রস্থ হয়, তখন হৃৎপিণ্ডের কোষ কিংবা হৃৎপেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। তার ফলে যে সমস্যা সৃষ্টি হয় যেগুলোকে এক নামে হার্ট অ্যাটাক নামে ডাকা হয়। হৃৎপিণ্ড রক্তের মাধ্যমে অক্সিজেন এবং খাবারের সারবস্তু অর্থাৎ পুষ্টিকর পদার্থ রক্তনালির মধ্য দিয়ে দেহের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দেয়। নিজের কাজ সঠিকভাবে করার জন্য অর্থাৎ তার হৃদপেশির অক্সিজেন এবং পুষ্টি অর্জনের জন্য হৃৎপিণ্ডের তিনটি প্রধান রক্তনালি আছে। এগুলোর মধ্যে অনেক সময় চর্বি জমে রক্ত চলাচলে ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। ফলে প্রাণঘাতী রোগ হার্ট অ্যাটাক হয়। অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস যেমন অধিক তেলযুক্ত খাবার অলস জীবনযাপন  এবং শারীরিক পরিশ্রম না করার ফলে এই রোগ দেখা যায়।

রক্তে উচ্চ কোলেস্টেরোল: 

দেহের অন্যান্য অঙ্গের মতো হৃৎপিণ্ডে অক্সিজেন এবং খাদ্যসার সবরাহের প্রয়োজন হয়। হৃৎপিণ্ডের করোনারি ধমনিগাত্রে চর্বি জমা হলে ধমনিতে স্বাভাবিক রক্ত প্রবাহে বিঘ্ন ঘটে ফলে হৃৎপিণ্ড পর্যাপ্ত অক্সিজেন এবং খাদ্যসার না পাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্থ হয়। রক্ত চলাচল কমে যাওয়ার কারণে বুকে ব্যথা অনুভূত হয়। এই অবস্থাকে অ্যানজিনা (Angina) বলা হয়। এছাড়া ধমনির গায়ে বেশি চর্বি জমা হলে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্থ হয় ফলে করোনারি হৃৎরোগের সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যায়।

লিউকেমিয়া (Leukemia) : 

যদি কোনো কারণে রক্তে অস্বাভাবিক শ্বেত কণিকার বৃদ্ধি ঘটে তাহলে এই রোগের লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়। অস্থিমজ্জা অত্যাধিক হারে শ্বেত রক্তকোষ উৎপাদন করার কারণে পরোক্ষভাবে লোহিত রক্তকোষ এবং অনুচক্রিকার উৎপাদন কমে যেতে পারে। লোহিত রক্তকোষের অভাবে অক্সিজেনের ঘাটতি হয় যার ফলে রোগী দুর্বল বোধ করে, ফ্যাকাশে হয়ে যায়, এবং শ্বাসকষ্ট হয়। অনুচক্রিকার অভাবে রক্ত জমাট বাঁধতে না থেকে অনেকসময় কোনো আঘাত ছাড়াই অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হয়। কিন্তু অধিক হারে শ্বেত রক্তকোষ উৎপন্ন হলেও সেগুলো আসলে ক্যান্সার কোষ এবং শ্বেতকোষের স্বাভাবিক কাজ, রোগপ্রতিরোধে অক্ষম। তাই লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তি সহজেই বিভিন্ন রোগজীবাণু দিয়ে আক্রান্ত হন। এভাবে রক্তের তিন ধরনের কোষের প্রায় প্রতিটিরই স্বাভাবিক কাজ ঠিকমতো না করতে পারা এ রোগের লক্ষণ, তবে লিউকেমিয়ার প্রকারভেদ অনুসারে লক্ষণের তারতম্য হতে পারে।

৪.৪ মানবদেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (Defense Mechanism )

মানব দেহের দৃশ্যমান গঠন এবং তার দেহের নানা ধরণের সমন্বিত কার্যক্রম আমরা প্রতিমূহুর্তে দেখতা পাই, এবং বিস্মিত হই, কিন্তু আমাদের চোখের আড়ালে চারপাশের অসংখ্য রোগ জীবাণু বা বিষাক্ত এবং দূষিত পদার্থের আক্রমণ থেকে শরীরকে রক্ষা করার জন্য আমদের দেহ যে একটি অবিশ্বাস্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে সেটি আমরা দেখতে পাই না, কিন্তু যে কোন হিসেবে সেটি একটি চমকপ্রদ ব্যবস্থা। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় একদিকে যেরকম বাহ্যিক ভৌত প্রতিবন্ধকতা রয়েছে থিক একি রকম অত্যন্ত নিখুঁত ইমিউন ব্যবস্থা রয়েছে যেটি রগ, জীবাণু ভাইরাস ভরপুর এই পৃথিবীর প্রতিকূল পরিবেশে আমাদের রক্ষা করে যাছে। কাজেই আমরা বলতে পারি, মানবদেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হলো বিভিন্ন জৈবিক কাঠামো সহযোগে গঠিত একটি ব্যবস্থা যা জীবদেহকে রোগব্যধির বিরুদ্ধে কাজ করে থাকে। মানবদেহের এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় এই ৩টি প্রতিরক্ষা স্তর (defense lines) হিসেবে ভাগ করা যায়।

৪.৪.১ প্রথম প্রতিরক্ষা স্তর (First line of Defense)

মানবদেহের প্রতিরক্ষায় যে প্রতিরক্ষা স্তরটি রাসায়নিক ও ভৌত প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে বহিরাগত যে কোনো অণুজীব বা কণাকে দেহের ভিতরে প্রবেশ করতে বাধা দেয় তাকে প্রথম প্রতিরক্ষা স্তর (First line of Defense) বলে। এটি সুনির্দিষ্ট কোন অণুজীব বা কণার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টি না করে যেহেতু একটি সাধারণ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলে তাই এই প্রতিরক্ষা স্তরটি অনির্দিষ্ট বা নন-স্পেসিফিক স্তর নামে পরিচিত। নিচের অঙ্গগুলো এই প্রতিরক্ষা স্তরের গুরুত্বপুর্ণ প্রতিরোধ গড়ে তুলে।

First line of Defense

ক. ত্বক (skin): 

ত্বক আমাদের শরীরের সবচেয়ে বড় অঙ্গ এবং এটি বায়ুরোধী, জলাভেদ্য (waterproof) এবং অধিকাংশ পদার্থের জন্য অভেদ্য। ত্বক ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস অথবা ফানজাইয়ের বিরুদ্ধে প্রথম কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলে। কতকগুলো ভাইরাস ছাড়া এমন কোনো রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু নেই যা অক্ষত ত্বকের ভিতরে প্রবেশ করতে পারে। মানবত্বকে উপকারী ব্যাকটেরিয়া সব সময়ই থাকে, কিন্তু ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া সেখানে বাঁচতে পারে না। কারণ ত্বকের স্বেদ ও ঘাম গ্রন্থি থেকে যথাক্রমে যে তেল ও ঘাম ক্ষরিত হয় তা ত্বককে এসিডিক করে তুলে, যে পরিবেশে জীবাণু বাঁচতে বা বংশবৃদ্ধি করতে পারে না। অন্যদিকে, ত্বকে যে সব বা উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে সেগুলোও যে এসিড ও বিপাকীয় বর্জ্য ত্যাগ করে সে সব পদার্থও ত্বকের উপরে ব্যাকটেরিয়া দমনে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। স্বেদ ও ঘাম গ্রন্থির ক্ষরণেও জীবাণুনাশক পদার্থ থাকে। এসব পদার্থ থাকায় মানুষের ত্বক একটি রোগজীবাণুনাশক অঙ্গ হিসেবে কাজ করে।

খ. লোম (Hairs):

 নাকের ভিতরকার লোম ধূলা-ময়লা আটকে দেহের অভ্যন্তরে ক্ষতিকর পদার্থের যাতায়াত বন্ধ করে রাখে।

গ. সিলিয়া (Cilia): 

দেহের প্রবেশ পথগুলো মিউকাস ঝিল্লিতে আবৃত থাকে। বহিরাগত কণা ও অণুজীব এ ঝিল্লির আঠালো মিউকাসে আটকে যায়। মিউকাস ঝিল্লিময় অনেক অংশ (যেমন- শ্বাসনালি) আণুবীক্ষণিক ক্ষুদ্র চুলের মত আন্দোলনরত সিলিয়ায় আবৃত থাকে, সেগুলো এই বহিরাগত কণা ও অণুজীবকে সরিয়ে দিয়ে দেহের প্রবেশপথকে উন্মুক্ত রাখে।

ঘ. অশ্রু ও লালা (Tears and Saliva): 

অশ্রু ও লালায় লাইসোজাইম (lysozyme) নামে যে এনজাইম রয়েছে তা ব্যাকটেরিয়ানাশক হিসেবে কাজ করে। লালা মুখগহ্বরকে শুধু সিক্ত ও পিচ্ছিল রাখে না, গহ্বরের প্রাচীর যেন শুকিয়ে ফেটে না যায় সে কাজও করে।এ কারণে কেনো জীবিত ব্যাকটেরিয়া মুখের ক্ষতি করতে পারে না, বরং লালামিশ্রিত হয়ে সরাসরি পাকস্থলিতে পৌঁছে সেখানকার আরও শক্তিশালী এসিডের ক্রিয়ায় বিনষ্ট হয়। অশ্রু চোখকে বারবার ভিজিয়ে দিয়ে সেটিকে বহিরাগত কণা ও অণুজীবের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে।

ঙ. সিরুমেন (Cerumen or Ear wax): 

বহিঃকর্ণের কর্ণকুহর নামক অংশের প্রাচীর থেকে ক্ষরিত হলদে-বাদামি রংয়ের মোমের মতো পদার্থকে সিরুমেন বলে। কানের পর্দায় যেন ময়লা ও অণুজীবের সংক্রমণে শ্রবণে ব্যাঘাত না ঘটে সেজন্য সিরুমেনে আটকে শক্ত দলায় (অর্থাৎ কানের খইলে) পরিণত হয়।

চ. পৌষ্টিকনালির এসিড (Acid of Alimentary canal): 

খাদ্য ও পানির সঙ্গে অনেক ধরনের ক্ষতিকর অণুজীব পাকস্থলিতে এসে জমা হয় এবং পাকস্থলির শক্তিশালী হাইড্রোক্লোরিক এসিড ও প্রোটিওলাইটিক এনজাইমের ক্রিয়ায় সেগুলো বিনষ্ট হয়।

ছ. রেচন-জননতন্ত্রের এসিড (Acid of Excretory reproductive system):

 রেচন-জননতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত অঙ্গের ক্ষরণ প্রচন্ড এসিডিক ও আঠালো হয়ে থাকে। অনুপ্রবেশিত অণুজীব সহজেই আঠালো ক্ষরণে আটকে যায় এবং পরে ফ্যাগোসাইট এগুলোকে গ্রাস করে বা মূত্রত্যাগের সময় সবেগে নিষ্ক্রান্ত হয়। যোনিতে অবস্থিত ব্যাকটেরিয়া ল্যাকটিক এসিড ক্ষরণ করে অন্য অণুজীবের বংশবৃদ্ধির সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়।

৪.৪.২ দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা স্তর (Second line of Defense )

প্রথম প্রতিরক্ষা স্তর ভেদ করে যদি দেহের অভ্যন্তরে কোনো অণুজীব বা অণুকণা প্রবেশ করতে পারে তখন সেগুলোর বিরুদ্ধে শরীরের ইমিউন ব্যবস্থা যে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুলে তাকে দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা স্তর (Second line of Defense) বলে। কোষীয় ও রাসায়নিকপ্রতিরক্ষা (internal cellular and chemical defenses) নিয়ে গঠিত এই স্তরটিও প্রথম প্রতিরক্ষা স্তরের মত অনির্দিষ্ট বা নন-স্পেসিফিক। এই চৌকস প্রতিরোধ ব্যবস্থা শরীরের নিজের কোষ এবং বহিরাগত অণুজীবের মধ্যে পার্থক্য করতে পারে তাই শরীরের নিজের সুস্থ কোষের কোন ক্ষতি না করে বহিরাগত অণুজীবকে ধ্বংস করে দেয়। দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা স্তর নিচে বর্ণিত প্রতিরক্ষা পদ্ধতিগুলো নিয়ে নিয়ে গঠিত।

Second line of Defense


ক. ফ্যাগোসাইট (Phagocytes): 

যে বড় আকারের শ্বেত রক্তকণিকা অন্য অণুজীব, কোষ ও বহিরাগত কণা গ্রাস করে দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় অবদান রাখে তাকে ফ্যাগোসাইট বলে। রক্তে দুটি প্রধান ফ্যাগোসাইটিক কণিকা হচ্ছে নিউট্রোফিল ও ম্যাক্রোফেজ, এগুলো অস্থিমজ্জা থেকে উৎপন্ন হয়। দেহে জীবাণুর সংক্রমণ হলে তার প্রতি সাড়াদান হিসেবে নিউট্রোফিল রক্তে, আর ম্যাক্রোফেজ নির্দিষ্ট টিস্যুতে গিয়ে ফ্যাগোসাইটোসিস প্রক্রিয়ায় জীবাণু গ্রাস করে। ম্যাক্রোফেজ শুধু যে জীবাণু গ্রাস ও হজম করে তা নয়, এটি পুরনো রক্তকণিকা, মৃত টিস্যু-খন্ড ও কোষীয় ময়লা গ্রাস করে ধাঙ্গর কোষ হিসেবে কাজ করে।

খ. সহজাত মারণকোষ (Natural killer cells): 

এক ধরনের লিম্ফোসাইট জাতীয় বিশেষ শ্বেত রক্তকণিকা যা টিউমার কোষ ও ভাইরাসে আক্রান্ত কোষের প্লাজমাঝিল্লিতে কিছু নির্দিষ্ট পরিবর্তনকে শনাক্ত করে সেইসব কোষগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। এই বিশেষ শ্বেত রক্তকণিকার কোষকে সহজাত মারণকোষ (সংক্ষেপে NK-কোষ) বলে। NK-কোষের আক্রমণে টার্গেট কোষের ঝিল্লিতে একটি রন্ধ্রের সৃষ্টি হয় এবং তখন সেই নিউক্লিয়াসটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।

গ. প্রদাহ (Inflammation): 

শরীরের টিস্যুতে সংক্রমণজনিত দহন, রাসায়নিক বা আঘাতজনিত যন্ত্রণাদায়ক ক্ষত বা অন্য কোনো ধরনের ক্ষতি হলে সেখানে প্রদাহ হয়। অর্থাৎ আমরা দেখতে পাই ক্ষতস্থানটি লাল হয়ে যায়, উত্তপ্ত হয়, ফুলে যায় এবং সবশেষে ব্যথার প্রকাশ ঘটে। এটি আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার একধরণের বহিপ্রকাশ। যখন টিস্যু ক্ষতিগ্রস্থ হয় তখন সেখানে এক ধরণের রাসাউনিক নিষ্ক্রমণ হয় যেটি ক্ষতস্থানে রকতের বাড়তি প্রবাহ সৃষ্টি করে। এই বাড়তি রক্ত প্রবাহ ক্ষত স্থানে প্রয়োজনীয় ইমিউন কোষ এবং পুষ্টি নিয়ে আসে যা ক্ষতস্থানের নিরাময় দ্রুততর করে থাকে।

ঘ. কমপ্লিমেন্ট সিস্টেম (Complement system): 

কমপ্লিমেন্ট সিস্টেম হচ্ছে অন্ততঃ ২০ ধরনের প্লাজমা প্রোটিনে গঠিত এমন একটি গ্রুপ যা রক্তে সংবহিত হয়ে অন্যান্য প্রতিরক্ষা পদ্ধতিকে সহায়তা করে। স্বাভাবিক অবস্থায় এসব প্রোটিন নিষ্ক্রিয়ভাবে সংবহিত হয়। একবার যদি কোনো প্রোটিন সক্রিয় হয়ে উঠে তাহলে তা আরেকটি প্রোটিনকেও সক্রিয় করে তুলে। এভাবে সমস্ত প্রোটিন পরস্পরকে সক্রিয় করে স্পেসিফিক ও নন-স্পেসিফিক উভয় ধরনের প্রতিরক্ষা পদ্ধতিকে উজ্জীবিত করে দেয়। যার কারণে NK-কোষ দক্ষতার সঙ্গে টিউমার কোষ ধ্বংস করতে পারে।অণুজীবের গায়ে কমপ্লিমেন্ট সিস্টেম আটকে থেকে সহযোগিতা করে (চিনিয়ে দেয়) বলে নিউট্রোফিল ও ম্যাক্রোফেজ দ্রুত ক্ষতস্থানে পৌঁছে কোষভক্ষণ করতে পারে। শধু তাই নয় কমপ্লিমেন্ট সিস্টেম রক্তনালিকার প্রসারণ ঘটিয়ে প্রদাহ ত্বরান্বিত করে।

ঙ. ইন্টারফেরন (Interferon): 

ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এবং ভাইরাসের বংশবৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটাতে আক্রান্ত কোষ থেকে যে বিশেষ ধরনের ক্ষুদ্র সিগনালিং প্রোটিন উৎপন্ন ও ক্ষরিত হয় তাকে ইন্টারফেরন বলে। এটি মানবদেহের সহজাত ইমিউন ব্যবস্থাপনার অংশ। ব্যাপনের মাধ্যমে ইন্টারফেরন আশপাশের সুস্থ কোষে ছড়িয়ে পড়ে, ঐসব কোষের ঝিল্লিতে যুক্ত হয় এবং সুস্থ কোষগুলোকে এ ধরনের প্রোটিন সংশ্লেষে উদ্দীপ্ত করে, ফলে ভাইরাসের পক্ষে অন্য সুরক্ষিত কোষগুলোতে আক্রমণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।ইন্টারফেরন চিকিৎসার কাজেও ব্যবহার হয়। কৃত্রিম উপায়ে ইন্টারফেরন আলফা এবং ইন্টারফেরন বেটা তৈরি করা হয়েছে যেগুলো হেপাটাইটিস বি এবং সি এর মত ভাইরাল সংক্রমন প্রতিরোধের কাজে ব্যবহৃত হয়।

চ. জ্বর (Fever):

দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা স্তরের শেষ অস্ত্র হচ্ছে জ্বর। দৈহিক তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে তাকে জ্বর বলা হয়। ম্যাক্রোফেজ নামে শ্বেত কণিকা যখন ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা বহিরাগত কণাকে শনাক্ত ও আক্রমণ করে তখন কোষগুলো রক্তপ্রবাহে পাইরোজেন (pyrogen) নামক একধরণের জৈব অণু ক্ষরণ করে। মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজের পাশাপাশি দেহের তাপমাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। পাইরোজেন হাইপোথ্যালামাসের বিপাকীয় পরিবর্তন ঘটিয়ে দেহের তাপমাত্রাকে উচ্চতর মাত্রায় নির্ধারণ করায়। তখন শরীর কেঁপে জ্বর আসে। জ্বর হলে দেহকোষের বিপাকীয় হার বেড়ে যায়, প্রতিরক্ষা পদ্ধতি ও টিস্যুর ক্ষয়পূরণ দ্রুততর হয়। জ্বরশেষে পাইরোজেনের ক্ষরণ বন্ধ হয়ে যায়, তখন দেহের তাপমাত্রা আবার স্বাভাবিক হয়ে আসে।

৪.৪.৩ তৃতীয় প্রতিরক্ষা স্তর (Third line of Defense)

প্রথম ও দ্বিতীয় প্রতিরক্ষা স্তর কোনো নির্দিষ্ট রোগসৃষ্টিকারী অণুজীব বা কণাকে লক্ষ বা টার্গেট করে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলে না। সেদিক দিয়ে তৃতীয় প্রতিরক্ষা স্তর (Third line of Defense) ব্যতিক্রম। এই প্রতিরক্ষা স্তর দেহে অনুপ্রবেশকারী সুনির্দিষ্ট ধরনের বহিরাগত রোগসৃষ্টিকারী অণুজীব বা কণা ধ্বংস করে এবং প্রথমবার আক্রান্ত হওয়ার পর এসব নির্দিষ্ট ক্ষতিকর টার্গেটকে আজীবন মনে রেখে পরবর্তী যে কোনো আক্রমণের সময় দ্রুত ও কার্যকর সাড়া দেয়। এ স্তরের সামগ্রিক কর্মকান্ডটি ইমিউন সাড়া (immune response) নামে পরিচিত।তৃতীয় প্রতিরক্ষা স্তরে বৈশিষ্ট্যগুলো এরকম:

ক. টার্গেট: 

এই প্রতিরক্ষা স্তর বহিরাগত অণুজীব বা কণা শনাক্ত করে টার্গেটে পরিণত করতে পারে, একই সাথে নিজের স্বাস্থ্যবান কোষকে ক্যান্সার কোষের মত অসুস্থ, মৃতপ্রায় বা মৃতকোষ থেকে পৃথক করতে পারে। রোগসৃষ্টিকারী জীবাণুকে টার্গেট করার জন্য সেগুলোর পৃষ্ঠদেশের সুনির্দিষ্ট আণবিক মার্কারকে শনাক্ত করার প্রয়োজন হয়। টার্গেট শনাক্ত করার পর ঐ জীবাণুকে ধ্বংস করার উপযোগী ইমিউন কোষ তৈরি করা হয়।

খ. মেমরি কোষ: 

তৃতীয় প্রতিরক্ষা স্তরের সবচেয়ে চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি বহিরাগত অণুজীব বা কণার সংক্রমণ স্মৃতিতে ধরে রাখতে পারে। প্রথমবার কোনো একটি রোগসৃষ্টিকারী জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলার পর এই প্রতিরক্ষা স্তর দেহে মেমরি কোষ সৃষ্টি। যদি পরবর্তীতে একই জীবাণু আবার সংক্রমণের চেষ্টা করে তাহলে মেমরি কোষ সাথে সাথে সেটিকে শনাক্ত করে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলে। এভাবে তৃতীয় প্রতিরক্ষা স্তর বছরের পর বছর নির্দিষ্ট বহিরাগতের অনুপ্রবেশ দ্রুত ঠেকানোর চেষ্টা করে।

গ. সামগ্রিক প্রতিরক্কা: 

তৃতীয় প্রতিরক্ষা স্তর সমগ্র দেহকে রক্ষা করে। অনুপ্রবেশকারী জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা শুধুমাত্র দেহের নির্দিষ্ট অংশে কার্যকর না থেকে শরীরের যে কোনো অংশে কার্যকর হতে পারে।

ঘ. বি-সেল: 

বি-সেল এবং টি-সেল মানুষের ইমিউন প্রক্রিয়ার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দুইটি উপাদান। এই শ্বেতকণিকা গুলো অভিযোজিত ইমিউন প্রক্রিয়ার সাথে ঘনিষ্টভাবে যুক্ত। প্রত্যেকটি বি-সেল নির্দিষ্ট এন্টিজেনকে (একটি জীবানুর পৃষ্টদেশের সুনির্দিষ্ট আণবিক গঠন বা মার্কার) শনাক্ত করতে পারে এবং শনাক্ত করার পর সেটি কার্যকর হয়ে উঠ দ্রুত বিভাজিত হতে শুরু করে। বি-সেল শনাক্তকারী জীবাণুকে প্রতিরোধ করার জন্য এন্টিবডি তৈরি করে সেগুলোকে রক্তের মাঝে ছড়িয়ে দেয়। এ ছাড়াও প্রতিরোধ শেষে এই জীবাণুকে পরবর্তীতে শনাক্ত করার জন্য কিছু বি-সেল পরিবর্তিত হয়ে মেমোরি ক্ষয়ে পরিণত হয়।

ঙ. টি-সেল:

 টি-সেল কোন এন্টিবডি তৈরি করে না কিন্তু ইমিউন প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কখনো কখনো এগুলো সরাসরি সংক্রামিত কোষকে আক্রমণ করে কখনো কখনো NK-কোষ বা অন্য ধরণের ইমিউন কোষকে উজ্জীবিত করে। বি-সেলের মত এই কোষগুলোও মেমোরি সেল তৈরি করে। পরবর্তী সংক্রমণ প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত থাকে।

T-Cell

টীকা বা ভ্যাক্সিন দিয়ে পৃথিবীর অসংখ্য জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়েছে। এই টীকা বা ভ্যাক্সিন তৈরি করার পিছনে তৃতীয় প্রতিরক্ষা স্তরের অভিযোজন প্রক্রিয়ার ধারণাটি কাজ করে থাকে। যে জীবাণুর বিরুদ্ধে টীকা তৈরি করা হয় সেই জীবাণুটি কিংবা তার এন্টিজেনকে দুর্বল বা অকার্যকর হিসেবে শরীরে প্রবেশ করানো হয়। শরীরের তৃতীয় প্রতিরক্ষা স্তর সাথে সাথে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে প্রয়োজনীয় এন্টিবডি এবং মেমোরি কোষ তৈরি করে। পরবর্তীতে সেই জীবাণুর সত্যিকারের সংক্রমণ হলে সাথে সাথে তার বিরুদ্ধে ইমিউন প্রক্রা কার্যকর হয়ে উঠে আমাদের সুরক্ষা দিয়ে থাকে।

এইচএসসি ICT৩য় অধ্যায় সংখ্যাপদ্ধতি ডিজিটাল ডিভাইস (১ম অংশ)-QUIZ-3

অর্ডিনেট আইটির আইসিটি(HSC) সকল কোর্সের ফ্রি ভিডিও ক্লাস


নতুন শিক্ষা কার্যক্রম পরীক্ষা নেওয়ার নিয়ম(কৌশল বা পদ্ধতি)-২০২৪

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনেট আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url