এইচ এস সি বাংলা ১ম পত্র সিরাজউদ্দৌলা পাঠ-৪
পাঠ-৪
সিরাজউদ্দৌলা
সিকান্দার আবু জাফর
এ পাঠটি পড়ে তুমি--
- সিরাজউদ্দৌলার পারিবারিক জীবন সম্পর্কে অবহিত হবা।
- সিরাজের নবাবের দ্রুত পতনের কাহিনি জানতে পারবা।
আরো পড়ুন: এইচএসসি বাংলা ১ম পত্র নাটক :সিরাজউদ্দৌলা
এই অধ্যায়ের উপর আরো পড়ুন: এইচএসসি বাংলা ১ম পত্র সিরাজউদ্দৌলা পাঠ ১
এই অধ্যায়ে উপর আরো পড়ুন :এইচএসসি বাংলা ১ম পত্র সিরাজউদ্দৌলা পাঠ-২
এই অধ্যায়ের উপর আরো পড়ুন: এইচএসসি বাংলা ১ম পত্র সিরাজউদ্দৌলা পাঠ-৩
এই অধ্যায়ের উপর আরো পড়ুন: এইচ এস সি বাংলা ১ম পত্র সিরাজউদ্দৌলা পাঠ-৪
এই অধ্যায়ের উপর আরো পড়ুন: এইচ এস সি বাংলা ১ম পত্র সিরাজউদ্দৌলা পাঠ-৫
এই অধ্যায়ের উপর আরো পড়ুন: বাংলা ১ম পত্র নাটক সিরাজউদ্দৌলা সিকান্দার আবু জাফর(Admission Test)
তৃতীয় অংক : প্রথম দৃশ্য
স্থান : লুৎফুন্নিসার কক্ষ
সময় : ১৭৫৭ সাল, ১০ থেকে ২১ জুনের মধ্যে যে কোনো একদিন।
[চরিত্রবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে-- ঘসেটি, লুৎফা, আমিনা, সিরাজ, পরিচারিকা]
(নবাব-জননী আমিনা বেগম ও লুৎফুন্নিসা উপবিষ্ট। ঘসেটি বেগমের প্রবেশ)
ঘসেটি : বড় সুখে আছো রাজমাতা আমিনা বেগম।
লুৎফা : আসুন খালাম্মা। (সালাম করল)
ঘসেটি : বেঁচে থাকো। সুখী এবং সৌভাগ্যবতী হও এমন দোয়া করলে সেটা আমার পক্ষে অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। তাই সে দোয়া করতে পারলুম না।
আমিনা : ছিঃ বড় আপা। এসো কাছে এসে বসো।
ঘসেটি : বসতে আসিনি। দেখতে এলাম কত সুখে আছো তুমি। পুত্র নবাব, পুত্রবধু নবাব বেগম, পৌত্রী শাহজাদি-
আমিনা : সিরাজ তোমারও তো পুত্র। তুমিও তো কোলে পিঠে করে তাকে মানুষ করেছো।
ঘসেটি : অদৃষ্টের পরিহাস- তাই ভুল করেছিলাম। যদি জানতাম বড় হয়ে সে একদিন আমার সৌভাগ্যের অন্তরায় হবে, যদি জানতাম অহরহ সে আমার দুশ্চিন্তার একমাত্র কারণ হয়ে দাঁড়াবে, জীবনের সমস্ত সুখ শান্তি সে গ্রাস করবে রাহুর মতো, তা হলে দুধের শিশু সিরাজকে প্রাসাদ চত্বরে আছড়ে মেরে ফেলতে কিছুমাত্র দ্বিধা করতাম না।
লুৎফা : আপনাকে আমরা মায়ের মতো ভালোবাসি। মায়ের মতোই শ্রদ্ধা করি।
ঘসেটি : থাক! যে সত্যিকার মা তার মহলেই তো চাঁদের হাট বসিয়েছ। আমাকে আবার পরিহাস করা কেন? দরিদ্রা রমণী আমি। নিজের সামান্য বিত্তের অধিকারিণী হয়ে এক কোণে পড়ে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মহাপরাক্রমশালী নবাব সে অধিকারটুকুও আমাকে দিলেন না।
আমিনা : কী হয়েছে তোমার? পুত্রবধূর সামনে এ রকম রূঢ় ব্যবহার করছ কেন?
ঘসেটি : কে পুত্র আর কে পুত্রবধূ? সিরাজ আমার কেউ নয়। সিরাজ বাংলার নবাব আমি তার প্রজা। ক্ষমতার অহংকারে উন্মত্ত না হলে আমার সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে সে সাহস করত না। মতিঝিল থেকে আমাকে সে তাড়িয়ে দিতে পারত না।
লুৎফা : শুনেছি আপনার কাছ থেকে কিছু টাকা তিনি ধার নিয়েছেন। কলকাতা অভিযানের সময়ে টাকার প্রয়োজন হয়েছিল তাই। কিন্তু গোলমাল মিটে গেলে সে টাকা তো আবার আপনি ফেরৎ পাবেন।
ঘসেটি : নবাব টাকা ফেরৎ দেবেন!
লুৎফা : কেন দেবেন না? তা ছাড়া সে টাকা তো তিনি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যয় করেননি। দেশের জন্য ঘসেটি : বড় সুখে আছো রাজমাতা আমিনা বেগম।
লুৎফা : আসুন খালাম্মা।
(সালাম করল)
ঘসেটি : বেঁচে থাকো। সুখী এবং সৌভাগ্যবতী হও এমন দোয়া করলে সেটা আমার পক্ষে অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। তাই সে দোয়া করতে পারলুম না।
আমিনা : ছিঃ বড় আপা। এসো কাছে এসে বসো।
ঘসেটি : বসতে আসিনি। দেখতে এলাম কত সুখে আছো তুমি। পুত্র নবাব, পুত্রবধু নবাব বেগম, পৌত্রী শাহজাদি-
আমিনা : সিরাজ তোমারও তো পুত্র। তুমিও তো কোলে পিঠে করে তাকে মানুষ করেছো।
ঘসেটি : অদৃষ্টের পরিহাস- তাই ভুল করেছিলাম। যদি জানতাম বড় হয়ে সে একদিন আমার সৌভাগ্যের অন্তরায় হবে, যদি জানতাম অহরহ সে আমার দুশ্চিন্তার একমাত্র কারণ হয়ে দাঁড়াবে, জীবনের সমস্ত সুখ শান্তি সে গ্রাস করবে রাহুর মতো, তা হলে দুধের শিশু সিরাজকে প্রাসাদ চত্বরে আছড়ে মেরে ফেলতে কিছুমাত্র দ্বিধা করতাম না।
লুৎফা : আপনাকে আমরা মায়ের মতো ভালোবাসি। মায়ের মতোই শ্রদ্ধা করি।
ঘসেটি : থাক! যে সত্যিকার মা তার মহলেই তো চাঁদের হাট বসিয়েছ। আমাকে আবার পরিহাস করা কেন? দরিদ্রা রমণী আমি। নিজের সামান্য বিত্তের অধিকারিণী হয়ে এক কোণে পড়ে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মহাপরাক্রমশালী নবাব সে অধিকারটুকুও আমাকে দিলেন না।
আমিনা : কী হয়েছে তোমার? পুত্রবধূর সামনে এ রকম রূঢ় ব্যবহার করছ কেন?
ঘসেটি : কে পুত্র আর কে পুত্রবধূ? সিরাজ আমার কেউ নয়। সিরাজ বাংলার নবাব আমি তার প্রজা। ক্ষমতার অহংকারে উন্মত্ত না হলে আমার সম্পত্তিতে হস্তক্ষেপ করতে সে সাহস করত না। মতিঝিল থেকে আমাকে সে তাড়িয়ে দিতে পারত না।
লুৎফা : শুনেছি আপনার কাছ থেকে কিছু টাকা তিনি ধার নিয়েছেন। কলকাতা অভিযানের সময়ে টাকার প্রয়োজন হয়েছিল তাই। কিন্তু গোলমাল মিটে গেলে সে টাকা তো আবার আপনি ফেরৎ পাবেন।
ঘসেটি : নবাব টাকা ফেরৎ দেবেন!
লুৎফা : কেন দেবেন না? তা ছাড়া সে টাকা তো তিনি ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ব্যয় করেননি। দেশের জন্যে--
ঘসেটি : থামো, লম্বা লম্বা বক্তৃতা করো না। সিরাজের বক্তৃতা তবু সহ্য হয়। তাকে বুকে পিঠে করে মানুষ করেছি। কিন্তু তোমার মুখে বড় বড় বুলি শুনলে গায়ে যেন জ্বালা ধরে যায়।
আমিনা : সিরাজ তোমার কোনো ক্ষতি করেনি বড় আপা।
ঘসেটি : তার নবাব হওয়াটাই তো আমার মস্ত ক্ষতি।
আমিনা : নবাবি সে কারো কাছ থেকে কেড়ে নেয়নি। ভূতপূর্ব নবাবই তাকে সিংহাসন দিয়ে গেছেন।
ঘসেটি : বৃদ্ধ নবাবকে ছলনায় ভুলিয়ে তোমরা সিংহাসন দখল করেছো।
আমিনা : আমরা।
ঘসেটি : ভাবছো যে বিস্মিত হবার ভঙ্গি করলেই আমি তোমাকে বিশ্বাস করব কেমন? তোমাকে আমি চিনি। তুমি কম সাপিনী নও।
আমিনা : তুমি অনর্থক বিষ উদগার করছো বড় আপা। তোমার এই ব্যবহারের অর্থ কিছুই বুঝতে পারছিনে।
ঘসেটি : বুঝবে। সেদিন আসছে। আর বেশিদিন এমন সুখে তোমার ছেলেকে নবাবি করতে হবে না।
(সিরাজের প্রবেশ)
সিরাজ : সিরাজউদ্দৌলা একটি দিনের জন্যেও সুখে নবাবি করেনি খালাআম্মা।
ঘসেটি : এসেছো শয়তান। ধাওয়া করেছো আমার পিছু।
সিরাজ : আপনার সঙ্গে প্রয়োজন আছে।
ঘসেটি : কিন্তু তোমার সঙ্গে আমার কোনো প্রয়োজন নেই।
সিরাজ : আমার প্রয়োজন আপনার সম্মতির অপেক্ষা রাখছে না খালাআম্মা।
ঘসেটি : তাই বুঝি সেনাপতি পাঠিয়ে আমাকে সংবাদ দিয়েছো যে তোমার আরও কিছু টাকার দরকার।
সিরাজ : খবর আপনার অজানা থাকার কথা না।
ঘসেটি : অর্থাৎ?
সিরাজ : অর্থাৎ আমি জানি যে, বাংলার ভাগ্য নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনার সমস্ত খবরই আপনি রাখেন। আরও স্পষ্ট করে শুনতে চান? আমি জানি যে, সিরাজের বিরুদ্ধে আপনার আক্রোশের কারণ আপনার সম্পত্তিতে সে হস্তক্ষেপ করেছে বলে নয়, রাজনৈতিক প্রাধান্য লাভের আশায় আপনি উন্মাদ। আমি অনুরোধ করছি আপনার সঙ্গে যেন কোনো প্রকারের দুর্ব্যবহার করতে বাধ্য করা না হয়।
ঘসেটি : তুমি আমাকে ভয় দেখাচ্ছ?
সিরাজ : আপনাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি।
ঘসেটি : তোমার এই চোখ রাঙাবার স্পর্ধা বেশিদিন থাকবে না। নবাব। আমিও তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি।
সিরাজ : আমার ভবিষ্যৎ ভেবে আপনি উৎকণ্ঠিত হবেন না খালাআম্মা। আপনার নিজের সম্বন্ধেই আমি আপনাকে সতর্ক করে দিচ্ছি। নবাবের মাতৃস্থানীয়া হয়ে তাঁর শত্রæদের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ রাখা বাঞ্ছনীয় নয়। অন্তত আমি আপনাকে সে দুর্নামের হাত থেকে রক্ষা করতে চাই।
ঘসেটি : তোমার মতলব বুঝতে পারছি না।
সিরাজ : রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ গোলযোগের সময়ে কোনো ক্ষমতাভিলাষী, স্বার্থপরায়ণ রমণীর পক্ষে রাজনীতির সঙ্গে যোগাযোগ রাখা দেশের পক্ষে অকল্যাণকর। আমি তাই আপনার গতিবিধির ওপরে লক্ষ রাখবার ব্যবস্থা করেছি। আমার প্রাসাদে আপনার স্বাধীনতা হস্তক্ষেপ করা হবে না। তবে লক্ষ রাখা হবে যাতে দেশের বর্তমান অশান্তি দূর হবার আগে বাইরের কারো সঙ্গে আপনি কোনো যোগাযোগ রাখতে না পারেন।
ঘসেটি : (ক্ষিপ্ত) ওর অর্থ আমি বুঝি মহামান্য নবাব। (দ্রুত আমিনার দিকে এগিয়ে এসে) শুনলে তো রাজমাতা আমাকে বন্দিনী করে রাখা হল। এইবার বল তো আমি তার মা, সে আমার পুত্র- তাই না? হা হা হা।
(অসহায় ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে বেরিয়ে গেলেন)
আমিনা : এসব লক্ষণ ভালো নয়। (উঠে দরজার দিকে এগোতে এগোতে) বড় আপা শুনে যাও, বড় আপা-
(বেরিয়ে গেলেন)
লুৎফা : খালাআম্মা বড় বেশি অপমানিত বোধ করেছেন। ওঁর সঙ্গে অমন ব্যবহার করাটা হয়ত উচিত হয়নি।
সিরাজ : আমার ব্যবহারে সবাই অপমান বোধ করছেন লুৎফা। শুধু অপমান নেই আমার।
লুৎফা : এ কথা কেন বলছেন জাঁহাপনা।
সিরাজ : তুমিও অন্ধ হলে আর কার কাছে আমি আশ্রয় পাবো বল তো লুৎফা। দেখতে পাচ্ছো না, শুধু অপমান নয় আমাকে ধ্বংস করবার আয়োজনে সবাই কী রকম মেতে উঠেছে।
লুৎফা : কিন্তু খালাআম্মা-
সিরাজ : আমাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারলে খালাআম্মা খুশি হবেন সবচেয়ে বেশি।
লুৎফা : অতটা বিশ্বাস করা কঠিন। তবে ওঁর মন আপনার ওপরে যথেষ্ট বিষিয়ে উঠেছে তা ঠিক। কিন্তু-
সিরাজ : থামলে কেন? বলো।
লুৎফা : বলাটা বোধ হয় ঠিক হবে না।
সিরাজ : বলো।
লুৎফা : বিধবা মেয়েমানুষ, ওঁর সম্পত্তিতে বারবার এমন হস্তক্ষেপ করতে থাকলে ভরসা নষ্ট হবারই কথা।
সিরাজ : লুৎফা, তুমিও আমার বিচার করতে বসলে। করো, আমি আপত্তি করব না। নানা মরবার পর থেকে এই ক-মাসের ভেতরে আমি এত বদলে গেছি যে, আমার নিকটতম তুমিও তা বুঝতে পারবে না।
লুৎফা : জাঁহাপনা।
সিরাজ : মনে পড়ে লুৎফা, নানার মৃত্যুশয্যায় আমি কসম খেয়েছিলাম শরাব স্পর্শ করব না। আমি তা করিনি। তুমিও জানো লুৎফা আমি তা করিনি।
লুৎফা : আমি ওসব কোনো কথাই তুলছিনে জাঁহাপনা।
সিরাজ : আমি জানি। সেই জন্যেই বলছি সব কিছু খুঁটিয়ে বিচার কর।
লুৎফা : আমি আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনবার জন্যে কোনো কথা বলিনি জাঁহাপনা। খালাআম্মা রাগে প্রায় কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে গেলেন তাই।
সিরাজ : তাই তোমার মনে হলো, ওঁর টাকা পয়সায় হাত দিয়েছি বলেই উনি আমার ওপর অতখানি বিরক্ত হয়েছেন। কিন্তু তুমি জানো না, কতখানি উৎসাহ নিয়ে উনি অজস্র অর্থ ব্যয় করেছেন শওকতজঙ্গের কামিয়াবির জন্যে। শুধু শওকতজঙ্গ কেন, আমার শত্রুদের শক্তি বৃদ্ধির জন্যেও ওঁর দান কম নয়।
লুৎফা : আমি মাপ চাইছি জাঁহাপনা, আমার অন্যায় হয়েছে?
সিরাজ : লুৎফা এত দেয়াল কেন বল তো?
লুৎফা : দেয়াল? কোথায় দেয়াল জাঁহাপনা?
সিরাজ : আমার চারপাশে লুৎফা। আমার সারা অস্তিত্ব জুড়ে কেবল যেন দেয়ালের ভিড়। উজির, অমাত্য, সেনাপতিদের এবং আমার মাঝখানে দেয়াল, দেশের নিশ্চিত শাসন ব্যবস্থা এবং আমার মাঝখানে দেয়াল, খালাআম্মা আর আমার মাঝখানে, আমার চিন্তা আর কাজের মাঝখানে, আমার স্বপ্ন আর বাস্তবের মাঝখানে, আমার অদৃষ্ট আর কল্যাণের মাঝখানে শুধু দেয়াল আর দেয়াল।
লুৎফা : জাঁহাপনা।
সিরাজ : আমি এর কোনোটি ডিঙিয়ে যাচ্ছি, কোনোটি ভেঙে ফেলছি, কিন্তু তবু তো দেয়ালের শেষ হচ্ছে না লুৎফা।
লুৎফা : আপনি ক্লান্ত হয়েছেন জাঁহাপনা।
সিরাজ : মসনদে বসবার পর থেকে প্রতিটি মুহূর্তে যেন দুপায়ের দশ আঙুলের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ক্লান্তি আসাটা কিন্তু অস্বাভাবিক নয়। সমস্ত প্রাণশক্তি যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে লুৎফা।
লুৎফা : সমস্ত দুশ্চিন্তা বাদ দিয়ে আমার কাছে দুএকদিন বিশ্রাম করুন।
সিরাজ : কবে যে দুদন্ড বিশ্রাম পাবো তার ঠিক নেই। আবার তো যুদ্ধে যেতে হচ্ছে।
লুৎফা : সে কী!
সিরাজ : আমার বিরুদ্ধে কোম্পানির ইংরেজদের আয়োজন সম্পন্ন। আমি এগিয়ে বাধা না দিলে তারা সরাসরি রাজধানী আক্রমণ করবে।
লুৎফা : ইংরেজদের সঙ্গে তো আপনার মিটমাট হয়ে গেল।
সিরাজ : হ্যাঁ, আলিনগরের সন্ধি। কিন্তু সে সন্ধির মর্যাদা একমাস না যেতেই তারা ধুলোয় লুটিয়ে দিয়েছে।
লুৎফা : কজন বিদেশি বেনিয়ার এত স্পর্ধা কী করে সম্ভব?
সিরাজ : ঘরের লোক অবিশ্বাসী হলে বাইরের লোকের পক্ষে সবই সম্ভব লুৎফা। শুধু একটা জিনিস বুঝে উঠতে পারিনে, ধর্মের নামে ওয়াদা করে মানুষ তা খেলাপ করে কী করে? নিজের স্বার্থ কি এতই বড়?
লুৎফা : কোনো প্রতিকার করতে পারেননি জাঁহাপনা?
সিরাজ : পারিনি। চেয়েছি, চেষ্টাও করেছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভরসা পাইনি। রাজবল্লভ, জগৎশেঠকে কয়েদ করে, মিরজাফরকে ফাঁসি দিলে হয়ত প্রতিকার হত, কিন্তু সেনাবাহিনী তা বরদাস্ত করত কি না কে জানে?
লুৎফা : থাক ওসব কথা। আজ আপনি বিশ্রাম করুন।
সিরাজ : আর কাল সকালেই দেশের পথে ঘাটে লোকের মুখে ছড়িয়ে পড়বে, যুদ্ধের আয়োজন ফেলে রেখে হারেমের কয়েকশ বেগমের সঙ্গে নবাবের উদ্দাম রসলীলার কাহিনি।
লুৎফা : মহলে বেগমের তো সত্যিই কোনো অভাব নেই।
সিরাজ : ঠাট্টা করছ লুৎফা? তুমি তো জানোই মরহুম শওকতজঙ্গের বিশাল হারেম বাধ্য হয়েই আমাকে প্রতিপালন করতে হচ্ছে।
লুৎফা : সে যাক। আজ আপনার বিশ্রাম। শুধু আমার কাছে থাকবেন আপনি। শুধু আমরা দুজন।
সিরাজ : অনেক সময়ে সত্যই তা ভেবেছি লুৎফা। তোমার খুব কাছাকাছি বহুদিন আসতে পারিনি। আমাদের মাঝখানে একটি রাজত্বের দেয়াল। মাঝে মাঝে ভেবেছি, এই বাধা যদি দূর হয়ে যেত। নিশ্চিন্ত সাধারণ গৃহস্থের ছোট সাজানো সংসার আমরা পেতাম।
পরিচারিকা : বেগম সাহেবা প্রবেশ)
লুৎফা : (তার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে) জাঁহাপনা এখন বিশ্রাম করছেন যাও।
পরিচারিকা : সেনাপতি মোহনলালের কাছ থেকে খবর এসেছে।
(পেছোতে লাগল)
লুৎফা : না।
(পরিচারিকার প্রস্থান)
সিরাজ : (এগিয়ে আসতে) মোহনলালের জরুরি খবরটা শুনতেই দাও লুৎফা।
(লুৎফা সিরাজের গতিরোধ করল)
লুৎফা : (আবেগজড়িত কণ্ঠে) না।
(সিরাজ থামল ক্ষণকালের জন্যে। লুৎফার দিকে মেলে রাখা নীরব দৃষ্টি ধীরে ধীরে স্নেহসিক্ত হয়ে উঠল।
কিন্তু পর মুহূর্তেই লুৎফার প্রসারিত বাহু ধীরে ধীরে সরিয়ে দিয়ে বের হয়ে গেল। লুৎফা চেয়ে রইল সিরাজের চলে যাওয়া পথের দিকে- দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল ওর দুগাল বেয়ে)
তৃতীয় অংক : দ্বিতীয় দৃশ্য
সময় : ১৭৫৭ সাল, ২২ জুন। স্থান : পলাশিতে সিরাজের শিবির।
[চরিত্রবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে- সিরাজ, মোহনলাল, মিরমর্দান, প্রহরী, বন্দি কমর]
(গভীর রাত্রি। শিবিরের ভেতরে নবাব চিন্তাগ্রস্তভাবে পায়চারি করছেন। দূর থেকে শৃগালের প্রহর ঘোষণার শব্দ ভেসে আসবে।)
সিরাজ : দ্বিতীয় প্রহর অতিক্রান্ত হলো। শুধু ঘুম নেই শেয়াল আর সিরাজউদ্দৌলার চোখে। (আবার নীরব পায়চারি) ভেবে আমি অবাক হয়ে যাই-
(মোহনলালের প্রবেশ। কুর্নিশ করে দাঁড়াতেই)
সিরাজ :সত্যি অবাক হয়ে যাই মোহনলাল, ইংরেজ সভ্য জাতি বলেই শুনেছি। তারা শৃঙ্খলা জানে, শাসন মেনে চলে। কিন্তু এখানে ইংরেজরা যা করছে সে তো স্পষ্ট রাজদ্রোহ। একটি দেশের শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তারা অস্ত্র ধরছে। আশ্চর্য!
মোহনলাল : জাঁহাপনা।
সিরাজ :হ্যাঁ, বলো মোহনলাল, কী খবর।
মোহনলাল : ইংরেজের পক্ষে মোট সৈন্য তিন হাজারের বেশি হবে না। অবশ্য তারা অস্ত্র চালনায় সুশিক্ষিত। নবাবের পক্ষে সৈন্য সংখ্যা পঞ্চাশ হাজারের বেশি। ছোট বড় মিলিয়ে ওদের কামান হবে গোটা দশেক। আমাদের কামান পঞ্চাশটার বেশি।
সিরাজ : এখন প্রশ্ন হলো আমাদের সব সিপাই লড়বে কিনা এবং সব কামান থেকে গোলা ছুটবে কিনা।
মোহনলাল : জাঁহাপনা।
সিরাজ :এমন আশঙ্কা কেন করছি তাই জানতে চাইছ তো? মিরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লুৎফ খাঁ নিজের নিজের সেনাবাহিনী নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু আমার বিশ্বাস করতে প্রবৃত্তি হয় না যে, ওরা ইংরেজের বিরুদ্ধে লড়বে।
মোহনলাল : সিপাহসালারের আরও একখানা গোপন চিঠি ধরা পড়েছে। (নবাবের হাতে পত্র দান। নবাব সেটা পড়ে হাতের মুঠোয় মুচড়ে ফেললেন।)
সিরাজ :বেইমান।
মোহনলাল : ক্লাইভের আরও তিনখানা চিঠি ধরা পড়েছে। সে সিপাহসালারের জবাবের জন্যে পাগল হয়ে উঠেছে মনে হয়।
সিরাজ : সাংঘাতিক লোক এই ক্লাইভ। মতলব হাসিল করার জন্যে যে কোনো অবস্থার ভেতর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওর কাছে সব কিছুই যেন একটা বড় রকমের জুয়ো খেলা।
(মিরমর্দানের প্রবেশ। যথারীতি কুর্নিশ করে একদিকে দাঁড়াল।)
সিরাজ : বলো মিরমর্দান।
মিরমর্দান : ইংরেজ সৈন্য লক্ষবাগে আশ্রয় নিয়েছে। ক্লাইভ এবং তার সেনাপতিরা উঠেছে গঙ্গাতীরের ছোটো বাড়িটায়। এখান থেকে প্রায় এক ক্রোশ দূরে।
সিরাজ : তোমাদের ফৌজ সাজাবার আয়োজন শেষ হয়েছে তো?
মিরমর্দান : (একটা প্রকান্ড নকশা নবাবের সামনে মেলে ধরে) আমরা সব গুছিয়ে ফেলেছি। (নকশা দেখাতে দেখাতে) আপনার ছাউনির সামনে গড়বন্দি হয়েছে। ছাউনির সামনে মোহনলাল, সাঁফ্রে আর আমি। আরও ডানদিকে গঙ্গার ধারে এই ঢিপিটার উপরে একদল পদাতিক আমার জামাই বদ্রি আলি খাঁর অধীনে যুদ্ধ করবে। তাদের ডান পাশে গঙ্গার দিকে একটু এগিয়ে নৌবে সিং হাজারির বাহিনী। বা দিক দিয়ে লক্ষবাগ পর্যন্ত অর্ধ চন্দ্রাকারে সেনাবাহিনী সাজিয়েছেন সিপাহসালার, রায়দুর্লভরাম আর ইয়ার লুৎফ খাঁ।
সিরাজ : (নকশার কাছ থেকে সরে এসে একটু পায়চারি করলেন) কত বড় শক্তি তবু কত তুচ্ছ মিরমর্দান।
মিরমর্দান : জাঁহাপনা।
সিরাজ : আমি কী দেখছি জানো? কেমন যেন অঙ্কের হিসেবে ওদের সুবিধার পাল্লা ভারী হয়ে উঠেছে।
মিরমর্দান :ইংরেজদের ঘায়েল করতে সেনাপতি মোহনলাল, সাঁফ্রে আর আমার বাহিনীই যথেষ্ট।
সিরাজ : ঠিক তা নয় মিরমর্দান। আমি জানি তোমাদের বাহিনীতে পাঁচ হাজার ঘোড় সওয়ার আর আট হাজার পদাতিক সেনা রয়েছে। তারা জান দিয়ে লড়বে। কিন্তু সমস্ত অবস্থাটা কী দাঁড়াচ্ছে, এসো তোমাদের সঙ্গে আলোচনা করি।
মোহনলাল : জাঁহাপনা।
সিরাজ : মিরজাফরদের বাহিনী সাজিয়েছে দূরে লক্ষবাগের অর্ধেকটা ঘিরে। যুদ্ধে তোমরা হারতে থাকলে ওরা দুকদম এগিয়ে ক্লাইভের সঙ্গে মিলবে বিনা বাধায়। যেন নিশ্চিন্তে আত্মীয় বাড়ি যাচ্ছে।
মিরমর্দান : কিন্তু আমরা হারব কেন?
সিরাজ : না হারলে ওরা যে তোমাদের ওপরেই গুলি চালাবে না তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। যাক, শিবিরের কাছে ওদের ফৌজ রাখবার কথা আমরাও ভাবিনা। কারণ, সামনে তোমরা যুদ্ধ করতে থাকবে, ওরা পেছনে নবাবের শিবির দখল করতে এক মুহূর্ত দেরি করবে না।
মোহনলাল : ওদের সেনা বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে না আনলেই বোধ হয়-
সিরাজ : এনেছি চোখে চোখে রাখার জন্যে। পেছনে রেখে এলে ওরা সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী দখল করতো।
মিরমর্দান :এত চিন্তিত হবার কারণ নেই জাঁহাপনা। আমাদের প্রাণ থাকতে নবাবের কোনো ক্ষতি হবে না।
সিরাজ : আমি জানি, তাই আরও বেশি করে ভরসা হারিয়ে ফেলছি। তোমাদের প্রাণ বিপন্ন হবে অথচ স্বাধীনতা রক্ষা হবে না, এই চিন্তাটাই আজ বেশি করে পীড়া দিচ্ছে।
মোহনলাল : আমরা জয়ী হবো জাঁহাপনা।
সিরাজ : পরাজিত হবে, আমিই কি তা ভাবছি। আমি শুধু অশুভ সম্ভাবনাগুলো শেষবারের মতো খুটিয়ে বিচার করে দেখছি। আগামীকাল তোমরা যুদ্ধ করবে কিন্তু হুকুম দেবে মিরজাফর। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনীতে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ এড়াবার জন্যে যুদ্ধের সর্বময় কর্তৃত্ব সিপাহসালারকে দিতেই হবে। কী হবে কে জানে। আমি কর্তব্য স্থির করতে পারছিনে, কিন্তু কেন যে পারছিনে আশা করি তোমরা বুঝছো।
মিরমর্দান : জাঁহাপনা।
সিরাজ : আজ আমার ভরসা আমার সেনাবাহিনীর শক্তিতে নয় মোহনলাল। আমার একমাত্র ভরসা, আগামীকাল যুদ্ধক্ষেত্রে বাংলার স্বাধীনতা মুছে যাবার সূচনা দেখে মিরজাফর, দুর্লভরাম, ইয়ার লুৎফদের মনে যদি দেশপ্রীতি জেগে ওঠে সেই সম্ভাবনাটুকু। (কিছুটা কোলাহল শোনা গেল বাইরে। দুজন প্রহরী এক ব্যক্তিকে নিয়ে হাজির হলো)
প্রহরী : হুজুর, এই লোকটা নবাবের ছাউনির দিকে এগোবার চেষ্টা করেছিল। (সঙ্গে সঙ্গে মোহনলাল বন্দির কাছে এগিয়ে এসে নবাবকে একটু যেন আড়াল করে দাঁড়াল। নবাব দুপা এগিয়ে এলেন। অপর দিক দিয়ে মিরমর্দান বন্দির আর এক পাশে দাঁড়াল)
বন্দি : (সকাতর ক্রন্দনে) আমি পলাশি গ্রামের লোক হুজুর। রৌশনি দেখতে এখানে এসেছি।
মোহনলাল : : (প্রহরীকে) তল্লাশি করো। (প্রহরী তল্লাশি করে কিছুই পেল না) কিন্তু একে সাধারণ গ্রামবাসী বলে মনে হচ্ছে না জাঁহাপনা।
মিরমর্দান : (প্রহরীকে) বাইরে নিয়ে যাও। কথা আদায় করো। (হঠাৎ দেখি দেখি। এ তো কমর বেগ জমাদার। মিরজাফরের গুপ্তচর উমর বেগের ভাই। এ ও গুপ্তচর।
কমর : (সহসা মাটিতে লুটিয়ে পড়ে) জাঁহাপনার কাছে বিচারের জন্যে এসেছি। আমাকে আসতে দেয় না, তাই চুরি করে হুজুরের কদম মোবারকে ফরিয়াদ জানাতে আসছিলাম।
সিরাজ : (কাছে এগিয়ে এসে) কী হয়েছে তোমার?
কমর : আমার ভাইকে সেনাপতি মোহনলালের হুকুমে খুন করা হয়েছে হুজুর।
সিরাজ : মোহনলাল।
মোহনলাল : গুপ্তচর উমর বেগ জমাদার হাতেনাতে ধরা পড়েছিল জাঁহাপনা। ক্লাইভের চিঠি ছিল তার কাছে। প্রহরীদের হাতে ধরা পড়বার পর সে পালাবার চেষ্টা করে। ফলে প্রহরীদের তলোয়ারের ঘায়ে সে মারা পড়েছে। (সিরাজ অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে মোহনলালের দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রইলেন)
মোহনলাল : (যেন দোষ ঢাকার চেষ্টায়) সে চিঠি জাঁহাপনার কাছে আগেই দাখিল করা হয়েছে।
সিরাজ : (মোহনলালের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে একটু পায়চারি করে চিন্তিতভাবে) কথায় কথায় মৃত্যুবিধান করাটাই শাসকের সবচাইতে যোগ্যতার পরিচয় কিনা সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ নই মোহনলাল।
কমর : জাঁহাপনা মেহেরবান।
সিরাজ : (প্রহরীদের) একে নিয়ে যাও। কাল যুদ্ধ শেষ হবার পর একে মুক্তি দেবে।
কমর : (রুদ্ধস্বরে) এই কি জাঁহাপনার বিচার?
সিরাজ : আমি জানি, এখানে এই অবস্থায় শুধু ফরিয়াদ জানাতেই আসবে এতটা নির্বোধ তুমি নও। (কঠোর স্বরে প্রহরীদের) নিয়ে যাও।
(বন্দি নিয়ে প্রহরীদের প্রস্থান) শৃগালের প্রহর ঘোষণা)
সিরাজ : তোমরাও এখন যেতে পারো। আজ রাতে তোমাদের বিশ্রামের প্রয়োজন। রাত প্রায় শেষ হয়ে এলো।
(মোহনলাল ও মিরমর্দান বেরিয়ে গেল। সিরাজ পায়চারি করতে লাগলেন। সোরাহি থেকে পানি ঢেলে
খেলেন। কোথায় একটা প্যাঁচা ডেকে উঠল। সিরাজ উৎকর্ণ হয়ে তা শুনলেন। কী যেন ভেবে রেহেলে
রাখা কোরান শরিফের কাছে গিয়ে জায়নামাজে বসলেন। কোরান শরিফ তুলে ওষ্ঠে ঠেকিয়ে রেহেলের
ওপর রেখে পড়তে লাগলেন। দূর থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে এলো। সিরাজ কোরান শরিফ মুড়ে
রাখলেন। “আসসালাতো খায়রুম মিনান্নাওম’- এর পর মোনাজাত করলেন। আস্তে আস্তে পাখির ডাক
জেগে উঠতে লাগল। হঠাৎ সূতীব্র তূর্যনাদ নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান করে দিল।)
তৃতীয় অংক : তৃতীয় দৃশ্য
সময় : ১৭৫৭ সাল, ২৩ জুন। স্থান : পলাশির যুদ্ধক্ষেত্র।
[চরিত্রবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে- সিরাজ, প্রহরী, সৈনিক, দ্বিতীয় সৈনিক, তৃতীয় সৈনিক, সাঁফ্রে, মোহনলাল, রাইসুল, জুহালা, ক্লাইভ, রাজবল্লভ, মিরজাফর, ইংরেজ সৈনিকগণ]
(গোলাগুলির শব্দ, যুদ্ধ কোলাহল। সিরাজ নিজের তাঁবুতে অস্থির ভাবে পায়চারি করছেন। সৈনিকের প্রবেশ।
সিরাজ : (উৎকণ্ঠিত) কী খবর সৈনিক?
সৈনিক : যুদ্ধের প্রথম মহড়ায় কোম্পানির ফৌজ পিছু হটে গিয়ে লক্ষবাগে আশ্রয় নিয়েছে। সিপাহসালার, সেনাপতি, রায়দুর্লভ এবং ইয়ার লুৎফ খাঁর সৈন্য যুদ্ধে যোগ দেয়নি।
সিরাজ : মিরমর্দান, মোহনলাল?
সৈনিক : ওরা শত্রæদের পিছু হটিয়ে লক্ষবাগের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন।
সিরাজ : আচ্ছা যাও। (সৈনিকের প্রস্থান। কোলাহল প্রবল হয়ে উঠল। দ্বিতীয় সৈনিকের প্রবেশ।)
২য় সৈনিক : দুঃসংবাদ জাঁহাপনা। সেনাপতি নৌবে সিং হাজারি ঘায়েল হয়েছেন।
সিরাজ : (কঠোর স্বরে ) যাও। (প্রস্থান। একটু পরে তৃতীয় সৈনিকের প্রবেশ)
৩য় সৈনিক : সেনাপতি মিরমর্দান তাই কামানের অপেক্ষা না করে হাতাহাতি লড়বার জন্যে দ্রæত এগিয়ে যাচ্ছেন।
সিরাজ : আর কোম্পানির ফৌজ যখন কামান ছুঁড়বে?
৩য় সৈনিক : শত্রুদের সময় দিতে চান না বলেই সেনাপতি মিরমর্দান শুধু তলোয়ার নিয়েই সামনে এগোচ্ছেন।
(দ্রুত প্রথম সৈনিকের প্রবেশ)
১ম সৈনিক : সেনাপতি বদ্রি আলি খাঁ নিহত জাঁহাপনা। যুদ্ধের অবস্থা খারাপ?
সিরাজ : না! যুদ্ধের অবস্থা খারাপ হয় না বদ্রি আলি ঘায়েল হলে। মিরমর্দান, মোহনলাল আছে। কোনো ভয় নেই, যাও।
(প্রথম ও তৃতীয় সৈনিকের প্রস্থান। হঠাৎ যুদ্ধ কোলাহল কেমন যেন আর্তচিৎকারে পরিণত হলো।)
সিরাজ : কী হলো? (টুলের ওপর দাঁড়িয়ে দূরবিন দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থা দেখবার চেষ্টা)
সিরাজ : (দ্রুত এগিয়ে এসে) কী খবর সাঁফ্রে? আমাদের পরাজয় হয়েছে?
সাঁফ্রে : (কুর্নিশ করে) এখনও হয়নি You Excellency. কিন্তু যুদ্ধের অবস্থা খারাপ হয়ে উঠেছে।
সিরাজ : শক্তিমান বীর সেনাপতি, তোমরা থাকতে যুদ্ধে হারতে হবে কেন? যাও, যুদ্ধে যাও সাঁফ্রে। জয়লাভ করো।
সাঁফ্রে : আমি তো ফ্রান্সের শত্রুদের বিরুদ্ধে লড়ছি জাঁহাপনা। দরকার হলে যুদ্ধক্ষেত্রে আমি প্রাণ দেব। কিন্তু আপনার বিরাট সেনাবাহিনী চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে standing like pillars.
সিরাজ : মিরজাফর, রায়দুর্লভকে বাদ দিয়েও তোমরা লড়াইয়ে জিতবে। আমি জানি তোমরা জিতবেই।
সাঁফ্রে : আমাদের গোলার আঘাতে কোম্পানির ফৌজ পিছু হটে লক্ষবাগে আশ্রয় নিচ্ছিল। এমন সময়ে এলো বৃষ্টি। হঠাৎ জাফর আলি খান আদেশ দিলেন এখন যুদ্ধ হবে না। মোহনলাল যুদ্ধ বন্ধ করতে চাইলেন না। কিন্তু সিপাহসালারের আদেশ পেয়ে tired soldiers যুদ্ধ বন্ধ করে শিবিরে ফিরতে লাগল। সুযোগ পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে কিলপ্যাট্রিক আমাদের আক্রমণ করেছে। মিরমর্দান তাদের বাধা দিচ্ছেন। কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজে বারুদ অকেজো হয়ে গেছে। তাঁকে এগোতে হচ্ছে কামান ছাড়া। | And that is dangerous
(২য় সৈনিকের প্রবেশ। কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল)
সিরাজ : কী সংবাদ?
ওমর খৈয়াম (১৯৬৬), সিংয়ের নাটক (১৯৭১)।
আরো পড়ুন: এইচএসসি বাংলা ১ম পত্র নাটক :সিরাজউদ্দৌলা
এই অধ্যায়ের উপর আরো পড়ুন: বাংলা ১ম পত্র নাটক সিরাজউদ্দৌলা সিকান্দার আবু জাফর(Admission Test)
(কিছু বলবার চেষ্টা করেও পারল না)
সিরাজ : (অধৈর্য হয়ে কাছে এসে প্রহরীকে ঝাঁকুনি দিয়ে) কী খবর, বলো কী খবর?
২য় সৈনিক : সেনাপতি মিরমর্দানের পতন হয়েছে জাঁহাপনা।
সাঁফ্রে : What? Mir Mardan killed?
সিরাজ : (যেন আচ্ছন্ন ) মিরমর্দান শহীদ হয়েছে?
সাঁফ্রে : The bravest soldier is dead. আমি যাই your excellency। আপনাকে কথা দিয়ে যাচ্ছি, ফরাসিরা প্রাণপণে লড়বে। (প্রস্থান)
সিরাজ : ঠিক বলেছো সাঁফ্রে, শ্রেষ্ঠ বাঙালি বীর যুদ্ধে শহিদ হয়েছে এখন তাহলে কী করতে হবে? সাঁফ্রে, মোহনলাল...
২য় সৈনিক : সেনাপতি মোহনলালকে খবর দিতে হবে জাঁহাপনা?
সিরাজ : মোহনলাল? না। নৌবে সিং বদ্রি আলি, মিরমর্দান সবাই নিহত। এখন কী করতে হবে? (পায়চারি করতে করতে হঠাৎ) হ্যাঁ আলিবর্দির সঙ্গে যুদ্ধ থেকে যুদ্ধে আমিই তো ঘুরেছি। বাংলার সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠ বীর সৈনিক সে তো আমি। যুদ্ধক্ষেত্রে আমি উপস্থিত নেই বলেই পরাজয় গুটি গুটি এগিয়ে আসছে। (সৈনিককে লক্ষ করে)
আমার হাতিয়ার নিয়ে এসো। আমি যুদ্ধে যাবো। আমার এতদিনের ভুল সংশোধন করার এই শেষ সুযোগ আমাকে নিতে হবে।
(মোহনলালের প্রবেশ)
মোহনলাল :না জাঁহাপনা। (সৈনিক বেরিয়ে গেল)
সিরাজ : মোহনলাল!
মোহনলাল : পলাশিতে যুদ্ধ শেষ হয়েছে জাঁহাপনা। এখন আর আত্মাভিমানের সময় নেই। আপনাকে অবিলম্বে রাজধানীতে ফিরে যেতে হবে।
সিরাজ : মিরজাফরের কাছে একবার কৈফিয়ৎ চাইব না?
মোহনলাল : মিরজাফর ক্লাইভের সঙ্গে যোগ দিল বলে। আর একটি মুহূর্তও নষ্ট করবেন না জাঁহাপনা। মুর্শিদাবাদে ফিরে আপনাকে নতুন করে আত্মরক্ষার প্রস্তুতি নিতে হবে।
সিরাজ : আমি একাই ফিরে যাবো?
মোহনলাল : আমার শেষ যুদ্ধ পলাশিতেই। আমি যাই জাঁহাপনা। সাঁফ্রে আর আমার যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। (নতজানু হয়ে নবাবের পরামর্শ করল। তারপর দ্বিতীয় কথা না বলে বেরিয়ে গেল।)
সিরাজ : (আত্মগতভাবে) যাও মোহনলাল। আর দেখা হবে না। আর কেউ রইল না। শুধু আমি রইলাম নতুন করে প্রস্তুতি নিতে হবে, মোহনলাল বলে গেল।
(২য় সৈনিকের প্রবেশ)
সৈনিক : দেহরক্ষী অশ্বারোহীরা প্রস্তুত, জাঁহাপনা। আপনার হাতিও তৈরি।
সিরাজ : চলো। (যেতে যেতে কী মনে করে দাঁড়ালেন)
সিরাজ : কে আছ এখানে?
(জনৈক প্রহরীর প্রবেশ)
সিরাজ : সেনাপতি মোহনলালকে খবর পাঠাও কয়েকজন ঘোড়সওয়ারের হেফাজতে মিরমর্দানের লাশ যেন এক্ষুণি মুর্শিদাবাদে পাঠানো হয়। উপযুক্ত মর্যাদার সঙ্গে মিরমর্দানের লাশ দাফন করতে হবে। (বেরিয়ে গেলেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে দুজন প্রহরী নবাব শিবিরের জিনিসপত্র গোছাতে লাগলো। রাইসুল জুহালার প্রবেশ)
রাইস : জাঁহাপনা তা হলে চলে গেছেন? রক্ষা।
প্রহরী : আমরা সবাই চলে যাচ্ছি।
রাইস : তার বোধ হয় সময় হবে না।
(বাইরে তুমুল কোলাহল)
রাইস : মিরজাফর ক্লাইভের দলবল এসে পড়ল বলে।
প্রহরী : তা হলে আর দেরি নয়, চলো সরে পড়া যাক।
(বেরিয়ে যাবার উদ্যোগ করতেই সশস্ত্র সৈন্যদের হাতে তারা বন্দি হল। সৈন্যদের সঙ্গে সঙ্গে এলো ক্লাইভ, মিরজাফর, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ)
ক্লাইভ : He has fled away. আগেই পালিয়েছে। (বন্দিদের কাছে এসে) কোথায় গেছে নবাব?
(বন্দিরা নিরুত্তর)
ক্লাইভ : (রাইসুল জুহালাকে বুটের লাথি মারল) কোথায় গেছে নবাব? Say quickly if you want to live বাঁচতে হলে জলদি করে বল।
রাইস : (হেসে উঠে মিরজাফরকে দেখিয়ে) ইনি বুঝি বাংলার সিপাহসালার? যুদ্ধে বাংলাদেশের জয় হয়েছে তো হুজুর?
রাজবল্লভ : যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে লোকটাকে?
ক্লাইভ : No time for fun, Come on, say, where is shiraj?
(আবার লাথি মারল)
রাইস : নবাব সিরাজউদ্দৌলা এখনও জীবিত। এর বেশি আর কিছু জানিনে।
রাজবল্লভ : চিনেছি, এ তো সেই রাইসুল জুহালা।
ক্লাইভ : He must be a spy
(টান মেরে পরচুলা খুলে ফেললো)
মিরজাফর : নারানসিং। সিরাজউদ্দৌলার প্রধান গুপ্তচর।
ক্লাইভ : গুলি করো ওকে-here and now
(দুজন গোরা সৈন্য নবাবের পরিত্যক্ত আসনের সঙ্গে পিঠমোড়া করে নারান সিংকে বাঁধতে লাগলো)
ক্লাইভ : (মিরজাফরকে) এখনই মুর্শিদাবাদের দিকে মার্চ করুন। বিশ্রাম করা চলবে না। সিরাজউদ্দৌলা যেন শক্তি সঞ্চয়ের সময় না পায়। (ক্লাইভ কথা বলছে, পিছনে গোরা সৈন্য দুজন নারান সিংকে গুলি করল। মিরজাফর, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ নিদারুণ শঙ্কিত। ক্লাইভ অবিচল। গুলিবিদ্ধ নারান সিংয়ের দিকে তাকিয়ে সহজ কন্ঠে বললো)
ক্লাইভ : গুপ্তচরকে এই ভাবেই সাজা দিতে হয়।
তৃতীয় অংক : চতুর্থ দৃশ্য
সময় : ১৭৫৭ সাল ২৫ জুন। স্থান : মুর্শিদাবাদ নবাব দরবার।
[চরিত্রবৃন্দ : মঞ্চে প্রবেশের পর্যায় অনুসারে- সিরাজ, ব্যক্তি, সৈনিক, অপর সৈনিক, বার্তাবাহক, দ্বিতীয় বার্তাবাহক, জনতা ও লুৎফা।]
(দরবারে গণ্যমান্য লোকের সংখ্যা কম। বিভিন্ন শ্রেণির সাধারণ মানুষের সংখ্যাই বেশি। স্তিমিত আলোয় সিরাজ বক্তৃতা করছেন। ধীরে ধীরে আলো উজ্জ্বল হবে।)
সিরাজ : পলাশির যুদ্ধে পরাজিত হয়ে আমাকে পালিয়ে আসতে হয়েছে, সে কথা গোপন করে এখন আর কোনো লাভ নেই। কিন্তু-
ব্যক্তি : প্রাণের ভয়ে কে না পালায় হুজুর?
সিরাজ : আপনাদের কি তাই বিশ্বাস যে, প্রাণের ভয়ে আমি পালিয়ে এসেছি?
(জনতা নীরব)
সিরাজ : না, প্রাণের ভয়ে আমি পালাইনি। সেনাপতিদের পরামর্শে যুদ্ধের বিধি অনুসারেই আমি হাল ছেড়ে দিয়ে বিজয়ী শত্রুর কাছে আত্মসমর্পণ করিনি। ফিরে এসেছি রাজধানীতে স্বাধীনতা বজায় রাখবার শেষ চেষ্টা করবো বলে।
ব্যক্তি : কিন্তু রাজধানী খালি করে তো সবাই পালাচ্ছে জাঁহাপনা!
সিরাজ : আমি অনুরোধ করছি, কেউ যেন তা না করেন। এখনও আশা আছে। এখনও আমরা একত্রে রুখে দাঁড়াতে পারলে শত্রæ মুর্শিদাবাদের ঢুকতে পারবে না।
ব্যক্তি : তা কী করে হবে হুজুর? অতবড় সেনাবাহিনী যখন ছারখার হয়ে গেল।
সিরাজ : তারা যুদ্ধ করে নি। তারা দেশবাসীর সঙ্গে, দেশের মাটির সঙ্গে প্রতারণা করেছে। কিন্তু যারা নিজের স্বার্থের চেয়ে দেশের স্বার্থ বড় করে দেখতে শিখেছিল, মুষ্টিমেয় সেই কজনই শুধু যুদ্ধ করে প্রাণ দিয়ে গেছে। এই প্রাণদান আমরা ব্যর্থ হতে দেবো না।
ব্যক্তি : পরাজয়ের খবর বাতাসের বেগে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে জাঁহাপনা। ঘরে ঘরে কান্নার রোল উঠেছে। বিজয়ী সৈন্যের অত্যাচার এবং লুঠতরাজের ভয়ে নগরের অধিকাংশ লোকজন তাদের দামি জিনিসপত্রগুলো সঙ্গে নিয়ে যে-কোনো দিকে পালিয়ে যাচ্ছে।
সিরাজ : আপনারা ওদের বাধা দিন। ওদের অভয় দিন। শত্রু সৈন্যদের হাতে পড়বার আগেই সাধারণ চোর-ডাকাত ওদের সর্বস্ব কেড়ে নেবে।
ব্যক্তি : কেউ মানে না হুজুর। সবাই প্রাণের ভয়ে পালাচ্ছে।
সিরাজ : কোথায় পালাবে? পেছনে থেকে আক্রমণ করার সুযোগ দিলে মৃত্যুর হাত থেকে পালানো যায় না। আপনারা কেউ অধৈর্য হবেন না। সবাইকে শক্ত হয়ে দাঁড়াতে বলুন। এই আমাদের শেষ সুযোগ, এ কথা বার বার করে বলছি। ক্লাইভের হাতে রাজধানীর পতন হলে এ দেশের স্বাধীনতা চিরকালের মতো লুপ্ত হয়ে যাবে।
ব্যক্তি : জাঁহাপনা, কোথায় বা পাওয়া যাবে তত বেশি সৈন্য আর কোথায় বা তার ব্যয় ব্যবস্থা!
সিরাজ : দুএক দিনের ভেতরেই বিভিন্ন জমিদারের কাছ থেকে যথেষ্ট সৈন্য আসবে। নাটোরের মহারাণীর কাছ থেকেও সৈন্য সাহায্য আসবে। অর্থের অভাব নেই। সেনাবাহিনীর খরচের জন্যে রাজকোষ উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। আপনারা বলুন কার কী প্রয়োজন।
সৈনিক : ইয়ার লুৎফ খাঁর সৈন্যদলে রোজ বেতনে আমি জমাদারের কাজ করি জাঁহাপনা। আমার অধীনে দুশ সিপাই। আমরা হুজুরের জন্যে প্রাণপণে লড়তে প্রস্তুত।
সিরাজ : বেশ, খাজাঞ্চির কাছ থেকে টাকা নিয়ে যান। আপনার সিপাইদের তৈরি হতে আদেশ দিন। মুর্শিদাবাদে এই মুহ‚র্তে অন্তত দশ হাজার সৈন্য সংগ্রহ হবে। জমিদারদের কাছ থেকে সাহায্য আসবার আগে এই বাহিনী নিয়েই আমরা শত্রুর মোকাবেলা করতে পারবো। অপর সৈনিক : আমি রাজা রাজবল্লভের অশ্বারোহী বাহিনীতে ঠিকা হারে কাজ করি। আমার মতো এমন আরও শতাধিক লোক রাজবল্লভের বাহিনীতে কাজ করে। জাঁহাপনার হুকুম হলে আমরা একটা ফৌজ অল্প সময়ের ভেতরে খাড়া করতে পারি।
সিরাজ : এখুনি চলে যান। খাজাঞ্চির কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিন, যত দরকার।
(বার্তাবাহকের প্রবেশ)
বার্তাবাহক : শহরে আরও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে জাঁহাপনা। মুহম্মদ ইরিচ খাঁ সাহেব এইমাত্র সপরিবারে শহর ছেড়ে চলে গেলেন।
সিরাজ : (বিস্ময় বিমূঢ়) ইরিচ খাঁ পালিয়ে গেলেন। সিরাজউদ্দৌলার শ্বশুর ইরিচ খাঁ। বার্তাবাহক : জাঁহাপনা।
সিরাজ : আশ্চর্য! এই কিছুক্ষণ আগে তিনি আমার কাছ থেকে অজস্র টাকা নিয়ে গেলেন সেনাবাহিনী সংগঠনের জন্যে।
ব্যক্তি : তাহলে আর আশা কোথায়?
সিরাজ : তা হলেও আশা আছে।
(দ্বিতীয় বার্তাবাহকের প্রবেশ)
২য় বার্তাবাহক : জাঁহাপনার কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহের জন্যে যারা টাকা নিয়েছে তাদের অনেকেই নিজেদের লোকজন নিয়ে শহর থেকে পালিয়ে যাচ্ছে।
সিরাজ : তাহলেও আশা। ভীরু প্রতারকের দল চিরকালই পালায়। কিন্তু তাতে বীরের মনোবল ক্ষুণœ হয় না। এমনি করে পালাতে পারতেন মিরমর্দান, মোহনলাল, বদ্রি আলি, নৌবেসিং। তার বদলে তাঁরা পেতেন শত্রæর অনুগ্রহ, প্রভ‚ত সম্পদ এবং সম্মান। কিন্তু তা তাঁরা করেননি। দেশের স্বাধীনতার জন্যে, দেশবাসীর মর্যাদার জন্যে, তাঁরা জীবন দিয়ে গেছেন। স্বার্থান্ধ প্রতারকের কাপুরুষতা বীরের সংকল্প টলাতে পারেনি। এই আদর্শ যেন লাঞ্ছিত না হয়। দেশপ্রেমিকের রক্ত যেন আবর্জনার স্তূপে চাপা না পড়ে।
(জনতা নীরব। সিরাজের অস্থির পদচারণা)
সিরাজ : সমস্ত দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে আপনারা ভেবে দেখুন, কে বেশি শক্তিমান? একদিকে দেশের সমস্ত সাধারণ মানুষ- অন্যদিকে মুষ্টিমেয় কয়েকজন বিদ্রোহী। তাদের হাতে অস্ত্র আছে, আর আছে ছলনা এবং শাঠ্য। অস্ত্র আমাদেরও আছে, আর আমাদের আছে সেই দেশপ্রেম এবং স্বাধীনতা রক্ষার সংকল্প। এই অস্ত্র দিয়ে আমরা কাপুরুষ দেশদ্রোহীদের অবশ্যই দমন করতে পারব।
ব্যক্তি : সাধারণ মানুষ তো যুদ্ধ কৌশল জানে না হুজুর।
সিরাজ : তবু তাদের সংঘবদ্ধ হতে হবে। হাজার হাজার মানুষ একযোগে রুখে দাঁড়াতে পারলে কৌশলের প্রয়োজন হবে না। বিক্রম দিয়েই আমরা শত্রুকে হতবল করতে পারব। তা না হলে, ভবিষ্যতে বছরের পর বছর, দেশের সাধারণ মানুষ দেশদ্রোহী এবং বিদেশি দস্যুর হাতে যেভাবে উৎপীড়িত হবে তা অনুমান করাও কষ্টকর। আপনারা ভেবে দেখুন, কেন এই যুদ্ধ? মুসলমান মিরজাফর, ব্রাহ্মণ রাজবল্লভ, কায়স্থ রায়দুর্লভ, জৈন মহাতাব চাঁদ শেঠ, শিখ উমিচাঁদ, ফিরিঙ্গি খৃষ্টান ওয়াটসন, ক্লাইভ আজ একজোট হয়েছে কিসের জন্যে? সিরাজউদ্দৌলাকে ধ্বংস করবার প্রয়োজন তাদের কেন এত বেশি? তারা চায় মসনদের অধিকার।
কারণ, তা না হলে তাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষা হয় না। দেশের ওপরে অবাধ লুঠতরাজের একচেটিয়া অধিকার তারা পেতে পারে না সিরাজউদ্দৌলা বর্তমান থাকতে। একবার সে সুযোগ পেলে তাদের আসলচেহারা আপনারা দেখতে পাবেন। বাংলার ঘরে ঘরে হাহাকারের বন্যা বইয়ে দেবে মিরজাফর ক্লাইভের লুণ্ঠন অত্যাচার। কিন্তু তখন আর কোনো উপায় থাকবে না। তাই সময় থাকতে একযোগে মাথা তুলে দাঁড়ান। আপনারা অবশ্যই জয়লাভ করবেন।
ব্যক্তি : কিন্তু জাঁহাপনা, সৈন্য পরিচালনার যোগ্য সেনাপতিও তো আমাদের নেই।
সিরাজ : আছে। সেনাপতি মোহনলাল বন্দি হননি। তিনি অবিলম্বে আমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন। তাছাড়া আমি আছি। মরহুম আলিবর্দির আমল থেকে এ পর্যন্ত কোনো যুদ্ধে আমি শরিক হইনি? পরাজিত হয়েছি একমাত্র পলাশিতে। কারণ সেখানে যুদ্ধ হয়নি, হয়েছে যুদ্ধের অভিনয়। আবার যুদ্ধ হবে, আর সৈন্য পরিচালনা করবো আমি নিজে। আমাদের সঙ্গে যোগ দেবেন বিহার থেকে রামনারায়ণ, পাটনা থেকে ফরাসি বীর মসিয়ে ল।
(বার্তাবাহকের প্রবেশ)
বার্তাবাহক : সেনাপতি মোহনলাল বন্দি হয়েছেন জাঁহাপনা।
সিরাজ : (কিছুটা হতাশ) মোহনলাল বন্দি হয়েছে?
জনতা : তাহলে আর কোনো আশা নেই। কোনো আশা নেই।
(জনতা দরবার কক্ষ ত্যাগ করতে লাগলো)
সিরাজ : মোহনলাল বন্দি? (কতকটা যেন আত্মসংবরণ করে) তা হলেও কোনো ভয় নেই। আপনারা হাল ছেড়ে দেবেন না।
(সিরাজ হাত তুলে পলায়নপর জনতাকে আশ্বাস দেবার চেষ্টা করতে লাগলেন। জনতা তাতে কান না
দিয়েই পালাতেই লাগলো)
সিরাজ : আমার পাশে এসে দাঁড়ান। আমরা শত্রুকে অবশ্যই রুখবো।
(সবাই বেরিয়ে গেল। অবসন্ন সিরাজ আসনে বসে পড়লেন। দুহাতে মুখ ঢাকলেন। ধীরে ধীরে সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এলো। লুৎফার প্রবেশ। মাথায় হাত রেখে ডাকলেন)
লুৎফা : নবাব।
সিরাজ : (চমকে উঠে) লুৎফা! তুমি এই প্রকাশ্য দরবারে কেন লুৎফা?
লুৎফা : অন্ধকারে ফাঁকা দরবারে বসে থেকে কোনো লাভ নেই নবাব।
সিরাজ : (রুদ্ধ কন্ঠে) কেউ নেই, কেউ আমার সঙ্গে দাঁড়াল না লুৎফা, দরবার ফাঁকা হয়ে গেল।
লুৎফা :(কাঁধে হাত রেখে) তবু ভেঙে পড়া চলবে না জাঁহাপনা। এখান থেকে যখন হলো না তখন যেখানে আপনার বন্ধুরা আছেন, সেখানে থেকেই বিদ্রোহীদের শাস্তি দেবার আয়োজন করতে হবে।
সিরাজ : যেখানে আমার বন্ধুরা আছেন ? হ্যাঁ, আপাতত পাটনায় যেতে পারলে একটা কিছু করা যাবে।
লুৎফা : তা হলে আর বিলম্ব নয় জাঁহাপনা। এখুনি প্রাসাদ ত্যাগ করা দরকার।
সিরাজ : হ্যাঁ, তাই যাই।
লুৎফা :আমি তার আয়োজন করে ফেলেছি।
সিরাজ : কী আর আয়োজন লুৎফা। দুতিন জন বিশ্বাসী খাদেম সঙ্গে থাকলেই যথেষ্ট। তোমরা প্রাসাদেই থাকো আবার যদি ফিরি, দেখা হবে।
লুৎফা :না, আমি যাবো আপনার সঙ্গে।
সিরাজ : মানুষের দৃষ্টি থেকে চোরের মতো পালিয়ে পালিয়ে আমাকে পথ চলতে হবে। সে কষ্ট তুমি সইতে পারব না লুৎফা।
লুৎফা :পারবো। আমাকে পারতেই হবে। বাংলার নবাব যখন পরের সাহায্যের আশায় লালায়িত তখন আমার কিসের অহঙ্কার? মৃত্যু যখন আমার স্বামীকে কুকুরের মতো তাড়া করে ফিরছে তখন আমার কিসের কষ্ট? আমি যাবো, আমি সঙ্গে যাবো। (কান্নায় ভেঙে পড়লেন। সিরাজ তাঁকে দুহাতে গ্রহণ করলেন)
শব্দের অর্থ
উইট্নেস (Witness)- সাক্ষী, প্রত্যক্ষদর্শী।
কমবখৎ-- হতভাগ্য।
খাজাঞ্চি-- কোষাধ্যক্ষ, খাজনার বা রাজকরের অধ্যক্ষ।
জানালা-- নারী, অন্তঃপুরাসিনী বা পর্দানশীল নারী।
তাকিয়া-- ঠেসান দেবার উপযোগী মোটা বালিকা।
দেওয়ান-- রাজস্ব বিভাগের মন্ত্রী।
ধড়িবাজ-- ধূর্ত, ফন্দিবাজ, প্রতারক।
ফরমান-- আদেশ।
ফরাস-- মেঝেতে পাতবার জন্য কাপড়ের আস্তরণ।
সওয়ারী-- যানবাহনে আরোহী।
Compensate-- ক্ষতিপূরণ করা।
অভয়-- আশ্বাস; সাহস।
অস্তিত্ব-- সত্তা।
আক্রোশ-- বিদ্বেষ, ক্রোধ।
আত্মাভিমান-- নিজের উপর নিজের অভিমান।
উৎকণ্ঠিত-- দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, চিন্তিত।
উদগার-- বমন।
উৎকর্ণ-- শুনবার জন্য অতিশয় ব্যগ্র।
কামিয়াবী-- সফলতা, কৃতকার্যতা।
কুর্নিশ--নবাবকে সম্মান দেখাবার জন্য পিছনে হটে গিয়ে অবনত মস্তকে সালাম।
ক্ষমতাভিলাসী-- ক্ষমতা লাভ করা যার ইচ্ছা।
খাজাঞ্চী-- কোষাধ্যক্ষ।
খাদেম--সেবক, ভৃত্য।
গড়বন্দী- এখানে পরিখা অর্থে।
গোরা-- ইংরেজ অর্থে, গৌরবর্ণ সৈনিক।
ঘায়েল-- নিহত অর্থে।
ঘোড়সওয়ার--অশ্বারোহী।
চাঁদের হাট-- শিশুদের বা সুন্দরীদের একত্র সবাবেশ, সুখ সম্পদপূর্ণ সংসার।
ছাউনী-- শিবির।
জমাদার-- ইংরেজ আমলে উচ্চপদস্থ ভারতীয় সৈনিক বিশেষ হেড কনস্টেবল।
জৈন-- মহাবীর-প্রবর্তিত ধর্মসম্প্রদায়।
ঠিকা-- অল্প সময়ের জন্য নিযুক্ত, নির্ধারিত শর্তযুক্ত।
ঢিপি-- উঁচু স্থান।
তুর্যনাদ--বর্ণবাদ্যের শব্দ।
দূরবীণ-- দূরের বস্তু স্পষ্ট রূপে দেখার যন্ত্র।
দেহরক্ষী অশ্বারোহী-- দেহ রক্ষায় নিযুক্ত অশ্বে আরোহনকারী সৈনিক।
দেয়াল-- বাধা, প্রতিবন্ধক অর্থে এখানে প্রযুক্ত।
পরিহাস-- ঠাট্টা, তামাশা।
পিঠমোড়া--দুই হাত পিঠের দিকে নিয়ে বাঁধা হয়েছে এমন।
প্রবৃত্তি--অভিরুচি।
প্রহর-- তিন ঘন্টা কাল; দিন রাতের আটভাগের একভাগ সময়।
ফিরিঙ্গি-- ভারতীয় ও ইউরোপীয়ের সংমিশ্রণে উৎপন্ন বর্ণশঙ্কর জাতি।
ফরিয়াদ-- নালিশ।
ফৌজ-- সৈন্য।
বরদাস্ত-- সহ্য করা, সহ্যকরণ।
বারুদ-- বিস্ফোরক চূর্ণ যা দিয়ে কামান বন্দুক ইত্যাদির গুলি প্রস্তুত হয়।
বেঈমানী-- বিশ্বাসঘাতকতা।
ভুতপূর্ব নবাব-- প্রাক্তন নবাব, এখানে নবাব মির্জা মুহম্মদ আলিবর্দি খাঁ।
মতলব-- অভিসন্ধি, উদ্দেশ্য।
মসনদ-- সিংহাসন, রাজাসন।
মহড়া-- আড়ম্বরের সঙ্গে প্রদর্শন।
মেহেরবান-- দয়ালু।
মৃত্যুবিধান-- মৃত্যুর আদেশ।
মহাপরাক্রমশালী-- মহাশক্তিশালী।
মাতৃস্থানীয়া-- মাতৃসম, মায়ের মত।
মোনাফেকি-- প্রতারণা, শঠতা।
রসলীলা-- প্রেমলীলা।
রাজকোষ-- রাজার বা রাষ্ট্রের ধনভান্ডার ।
রাজদ্রোহ-- রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ; রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে দ্রোহ।
রাজমাতা-- রাজার মা।
রেহেল-- যার উপর পবিত্র কুরআন শরিফ বা যে কোন বই রেখে পড়া হয়।
রৌশনি-- আলোক সজ্জা।
লালায়িত-- লোলুপ, অত্যন্ত আগ্রহান্বিত।
শাঠ্য-- শঠতা, ধূর্ততা।
শাহজাদী-- বাদশাহ্র কন্যা।
সংঘবদ্ধ-- দলবদ্ধ।
সাপিনী-- স্ত্রী-সাপ। এখানে সাপিনী স্বভাবের নারী অর্থে ব্যবহৃত।
সোরাহী-- জলের কুঁজো।
স্তিমিত--অনুজ্জ্বল।
হতবল-- বলহীন।
হেফাজত-- জিম্মাদারি, রক্ষণাবেক্ষণ।
হারেম-- অন্দরমহল, অন্তঃপুর।
হাসিল-- বুদ্ধি ও কৌশলে কার্য উদ্ধার।
হস্তক্ষেপ-- হাত দেওয়া, কোনো কাজে বাধা দেওয়া।
Excellency-- সম্রাট, গভর্নর, রাষ্ট্রদূত প্রমুখের পদবি।
Idiot--নির্বোধ।
Standing like pollar-- স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে আছে, স্থানুর মতো দাঁড়ানো অর্থে।
The bravest soldier-- বীরশ্রেষ্ঠ সৈনিক।
টীকা
আমিনা বেগম-বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার গর্ভধারিনী এবং প্রাক্তন নবাব আলিবর্দি খাঁর কনিষ্ঠ কন্যা। আলিবর্দির ভ্রাতৃষ্পুত্র জয়েনউদ্দিনের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়। জয়েনউদ্দিন যখন বিহারের সুবেদার তখন ১৭৪৮ সালে আফগান নৃপতি আহমদ শাহ দুররানী পাঞ্জাব আক্রমণ করলে বাংলার নবাবের বিদ্রোহী আফগান সেনাদল পাটনা অধিকার করে নেয়। এই বিদ্রোহীদের হাতেই আলিবর্দির জ্যেষ্ঠভ্রাতা হাজী আহম্মদ ও তার পুত্র জয়েনউদ্দিনের মৃত্যু হয়।
আমিনা বেগম বাংলার নবাব পরিবারের এক ভাগ্যহীনা নারী। তাঁর তিন পুত্রের মধ্যে মধ্যম পুত্র এক্রামউদ্দ্যেলা পলাশির যুদ্ধের পূর্বেই বসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। জ্যেষ্ঠপুত্র নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করার পর তার কনিষ্ঠপুত্র মির্জা মাহদিকেও মীরনের আজ্ঞাবাহী সৈন্যরা কাঠের পাটাতনে পিষ্ট করে নৃশংসভাবে হত্যা করে। আমেনা বেগমের হত্যাকান্ড ও মিরজাফরের নৃশংসতার দৃষ্টান্ত হয়ে রয়েছে। মিরজাফরের নির্দেশে হাত-পা বেঁধে মাঝনদীতে নিক্ষেপ করে বন্দিনী আমিনা বেগমের জীবন্ত সমাধি রচনা করা হয়।
আলিনগর- কলকাতা শহরের নতুন নাম। ১৭৫৬ সালের জুন মাসে কলকাতা দখল করে নবাব সিরাজউদ্দৌলা মাতামহের নামানুসারে শহরটির নামকরণ করেন আলিনগর। মানিকচাঁদ ছিলেন আলিনগরের নবাবনিযুক্ত প্রথম গভর্নর।
ইয়ার লুৎফ খাঁ- পলাশির যুদ্ধে মিরজাফরের সহযোগী সেনাপতি।
উমর বেগ জমাদার- মিরজাফরের বিশ্বস্ত গুপ্তচর।
এ্যাডমিরাল ওয়াট্সন- এ্যাডমিরাল চার্লস ওয়াটসন। ইংরেজ পক্ষের নৌবাহিনী প্রধান ওয়াট্সন ছিলেন ইংল্যান্ডের রাজকীয় নৌবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত অ্যাডমিরাল। সিরাজউদ্দৌলা কর্তৃক কলকাতা দখলের পর পাঁচটি যুদ্ধ জাহাজের বহর নিয়ে ওয়াটসন কলকাতা পৌঁছান এবং ক্লাইভের বাহিনীর সঙ্গে যোগদেন। ধূর্ত ক্লাইভের তুলনায় ওয়াট্সন ছিলেন ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন। নাটকে উমিচাঁদকে অর্থ ফাঁকি দেয়ার জন্য যে জাল দলিল প্রস্তুতের প্রসঙ্গ আছে, সেই জাল দলিলে ওয়াট্সন স্বাক্ষরদান করেননি। ক্লাইভ লুমিংটনকে নিয়ে ওয়াট্সনের স্বাক্ষর নকল করান। ওয়াট্সন পলাশি যুদ্ধের পর দু’মাস যেতে না যেতেই রোগভোগে মৃত্যুবরণ করেন। সেন্ট জোনা গোরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।
মিরন- পরলোকগত নবাব আলিবর্দি খাঁর ভগ্নিপতি ও নবাব সিরাজউদ্দৌলার প্রধান সেনাপতি মিরজাফরের জ্যেষ্ঠ পুত্র মিরন। ইনিও তার পিতার মতই ছিলেন বিশ্বাসঘাতক, ষড়যন্ত্রকারী ও নিষ্ঠুর। ভোগবিলাসে মত্ত ব্যভিচারী জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন মিরন। মিরজাফরের পক্ষে অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীর সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করতেন তিনি। তারই উদ্যোগ ও নির্দেশে মোহাম্মদি বেগ নিষ্ঠূরভাবে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করে। অকালে বজ্রাঘাতে মিরনের মৃত্যু হয়।
রবার্ট ক্লাইভ, কর্নেল- মাত্র সতেরো বছর বয়সে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চাকরি নিয়ে ভারতবর্ষে আসেন রবার্ট ক্লাইভ। সামান্য চাকুরীর ছকবাঁধা জীবনে হতাশগ্রস্ত ক্লাইভ আত্মহত্যার চেষ্টা সফল হয়নি। ভারতে ফরাসিদের সঙ্গে ইংরাজ বণিকদের যুদ্ধে ক্লাইভ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন। এরপর মারাঠা জলদস্যুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয় করে তিনি কর্নেল উপাধি লাভ করেন।
পলাশি যুদ্ধের শেষে ইনি নবাবের দখল করা ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ পুনরুদ্ধার করেন। তারই ষড়যন্ত্রে পলাশির যুদ্ধ এক প্রহসনে রূপান্তরিত হয়। ইনি নবাবের প্রধান সেনাপতি এবং প্রধান প্রধান অমাত্য বা মন্ত্রণাদাতাদের প্রলুব্ধ করে ইংরেজদের পক্ষাবলম্বনে রাজি করান। ফলে নবাবের প্রধান সেনাপতি মিরজাফরের পূর্ব পরিকল্পিত উদাসীনতা ও অপারগতার কারণে পলাশির যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন হয় এবং বাংলায় স্বাধীন নবাবি শাসনের অবসান ঘটে।
সারসংক্ষেপ :
নবাবের কাছে স্পষ্ট যে, তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে ইন্ধন যুগিয়েছেন খালা ঘসেটি বেগম। ফলে তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য নিযুক্ত করা হয়েছে গুপ্তচর বাহিনী। এতেই ঘসেটি বেগম অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। ঘসেটি বেগম নবাবকে ‘শয়তান’ অভিহিত করেন। সহধর্মিনী লুৎফা অন্তঃপুরে নবাবকে কিছুদিন বিশ্রামের অনুরোধ করেন। মোহনলালের কাছে থেকে পাওয়া জরুরি সংবাদের সূত্রে নবাবকে চলে যেতে হয়। পলাশির প্রান্তরের আসন্ন যুদ্ধে বিপর্যয়ের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন নবাব নিদ্রাহীন সময় অতিবাহিত করেন। রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে সেনাপতি মোহনলাল আসেন নবাবের কাছে।
বিশ্বাসঘাতক মিরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লুৎফ খাঁ প্রমুখ সেনাপতি নবাবের পক্ষ হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করবেন- এমন বিশ্বাস সিরাজের নেই। লর্ড ক্লাইভ ও মিরজাফরের একাধিক গোপন চিঠি ইতোমধ্যে মোহনলালের হস্তগত হয়েছে, ধরা পড়েছে বিশ্বাসঘাতক গুপ্তচরের দল। এ সময়েই সিরাজের শিবিরে আসেন নবাবের অন্যতম বিশ্বাসভাজন সেনাপতি মিরমর্দান। মিরমর্দান পলাশির যুদ্ধক্ষেত্রে নবাব পক্ষের কৌশল প্রণয়ন করেছেন।
যুদ্ধক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকদের না রাখার পক্ষে মোহনলাল অভিমত ব্যক্ত করলে সিরাজ এদের চোখে চোখে রাখার প্রয়োজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। তাঁর সর্বশেষ ভরসা আগামীকাল পলাশির ‘যুদ্ধক্ষেত্রে বাংলার স্বাধীনতা মুছে যাবার সূচনা দেখে মিরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লুৎফদের মনে যদি দেশপ্রীতি জেগে ওঠে সেই সম্ভাবনাটুকু’।
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশির প্রান্তরে ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে বাংলার নবাবের অনুগত বাহিনী মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়ে নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে পড়ে। মিরমর্দান ও মোহনলালের নেতৃত্বে পরিচালিত বাহিনীর আক্রমণে বাধ্য হয়ে প্রথমে পিছু হটে। যুদ্ধে প্রধান সেনাপতি মিরজাফর এবং সেনাপতি রায়দুর্লভ ও ইয়ার লুৎফ খাঁর সৈন্য যোগ দেয়নি। কিন্তু যুদ্ধে নৌবেসিং হাজারী নিহত হয় এবং বৃষ্টিতে নবাব পক্ষের বারুদ অকেজো হয়ে পড়ে। শঙ্কিত নবাব সৈনিকদের অভয় দেন। অনুগত ফরাসি সেনাপতি সাঁফ্রে নবাবের কাছে হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতির বর্ণনা দেন।
মিরমর্দানের মৃত্যু সংবাদ আসে। পরাজয় নিশ্চিত জেনে সেনাপতি মোহনলাল নবাবকে দ্রæত মুর্শিদাবাদে যাওয়ার পরামর্শ দেন। পলাশির যুদ্ধে পরাজিত নবাব রাজধানী রক্ষার্থে মুর্শিদাবাদ আসেন। মুষ্টিমেয় কিছু নাগরিকদের নবাব বোঝাতে চেষ্টা করেন যে, পলাশিতে যুদ্ধ সংঘটিতে হয়নি, হয়েছে যুদ্ধের অভিনয়। এখনও যদি সশস্ত্র প্রতিরোধ বর্ণনা করা যায় তাহলে দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করা সম্ভব। এ-সময় মোহনলালের বন্দী হওয়ার দুঃসংবাদ শুনে জনতা দরবার কক্ষ পরিত্যাগ করতে শুরু করে। এই বিপর্যয় মুহূর্তে বেগম লুৎফুন্নিসা নবাবকে পরামর্শ দেন মনোবল অক্ষুণœ রাখার। হিতৈষি বন্ধুবর্গের আশ্রয়ে থেকে তাদের সহায়তায় বিদ্রোহীদের শাস্তি দেবার উদ্যোগ গ্রহণ করতে নবাবকে অনুরোধ জানান লুৎফা।
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১৩. মিরজাফরের গুপ্তচর কে?
ক. উমর বেগ খ. জগৎ শেঠ
গ. মোহন লাল ঘ. শওকত জঙ্গ
১৪. সিরাজ কোনটিকে তাঁর চারপাশের ‘দেয়াল’ বলেছেন?
ক. অমাত্যদের ষড়যন্ত্রকে খ. লবণ বিক্রেতাদের
গ. ঘসেটি বেগমকে ঘ. লবণ উৎপাদনকারীদেরকে
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং ১৫ ও ১৬ নং প্রশ্নের উত্তর দিন :
বাঙালি শুধু লাঠি দিয়েই দেড়শত বছর আগেও তার স্বাধীনতাকে অক্ষুন্ন রাখতে চেষ্টা করেছে। আজ বাংলার ছেলেরা স্বাধীনতার জন্য যে আত্মদান করেছে, ইতিহাসে তা স্বর্ণ- লেখায় লিখিত থাকবে।
১৫. ‘সিরাজদ্দৌলা’ নাটকের সঙ্গে উদ্দীপকের কোন দিকটির মিল রয়েছে?
ক. বাঙালির স্বপ্নভঙ্গ খ. আত্মত্যাগের মহিমা
গ. ইংরেজদের পরাজয় ঘ. বাঙালির স্বাধীনতা লাভ
১৬. উদ্দীপক ও‘সিরাজদ্দৌলা’ নাটকে মিল রয়েছে যে বিষয়ে-
i. বাঙালির ত্যাগে
ii. বাঙালির প্রতিশোধ স্পৃহায়
iii. অমাত্যদের বিশ্বাসঘাতকতায়
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i খ. ii
গ. iii ঘ. i ও iii
অর্ডিনেট আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url