এইচ এস সি বাংলা ১ম পত্র অপরিচিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর || Admission test Lecture sheet bangla 1st Paper oparajita || এইচ এস সি বাংলা ১ম
অপরিচিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
লেখক-পরিচিতি
বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ৭মে (১২৬৮ বঙ্গাব্দের ২৫ বৈশাখ) কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। রবীন্দ্রনাথ বাবা-মা’র চতুর্দশ সন্তান ও অষ্টম পুত্র। তাঁর পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও মাতা সারদা দেবী। বাল্যকালে রবীন্দ্রনাথকে ওরিয়েন্টাল সেমিনারি, নর্মাল স্কুল, বেঙ্গল একাডেমি প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লেখাপড়ার জন্য পাঠানো হলেও বিদ্যালয়ের পড়ালেখার প্রতি তিনি মনোযোগী ছিলেন না।
ঠাকুর বাড়ির অনুকূল পরিবেশে শৈশবেই রবীন্দ্রনাথের কবি প্রতিভার উন্মেষ ঘটে। ১৮৭৬ সালে পনের বছর বয়সে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ বনফুল। অতঃপর কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, ভ্রমণসাহিত্য, রম্যরচনা, সঙ্গীত ইত্যাদি শাখায় রবীন্দ্রনাথ রেখে গেছেন তাঁর অসামান্য শিল্প প্রতিভার স্বাক্ষর। তাঁর হাতেই সম্পন্ন হয় বাংলা ছোটগল্পের ভিত্তি ও প্রতিষ্ঠা। মাত্র ষোল বছর বয়সে ‘ভিখারিনী’ গল্প রচনার মধ্য দিয়ে ছোটগল্প-লেখক হিসেবে তাঁর আবির্ভাব।
জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন গ্রন্থে মোট ১১৯টি ছোটগল্প লিখেছেন। তাঁর সর্বশেষ গল্পটির নাম ‘মুসলমানির গল্প’।গল্পরচনায় বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি ও বিশেষ করে শিলাইদহ তাঁকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল। এজন্য তাঁর গল্পে প্রকৃতি একটি বিশেষ চরিত্র হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। গীতিময়তা তাঁর গল্পেরআরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। কেবল সাহিত্যিক হিসেবেই নয়, একজন কর্মযোগী মানুষ হিসেবেও রবীন্দ্রনাথ তাঁর অনন্য কীর্তির পরিচয় রেখে গেছেন। ১৯০১ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়’।
এটিই পরবর্তীকালে‘বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়’-এ রূপলাভ করে। ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ তাঁর গীতাঞ্জলি (১৯১১) কাব্যের জন্য নোবেলপুরস্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশে প্রথম কৃষিব্যাংক স্থাপন করেন। বাংলাদেশের শিলাইদহ, পতিসর এবং শাহজাদপুরে জমিদারি তত্ত¡াবধান সূত্রে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের একটা উল্লেখযোগ্য সময় অতিবাহিত করেন। গীতিকার ও চিত্রশিল্পী হিসেবেও রবীন্দ্রনাথের অবদান অনন্য সাধারণ। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট (১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ২২ শ্রাবণ) কলকাতায় তিনি পরলোকগমন করেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য রচনা :
কাব্যগ্রন্থ : মানসী (১৮৯০), সোনার তরী (১৮৯৪), চিত্রা (১৮৯৬), ক্ষণিকা (১৯০০), গীতাঞ্জলি (১৯১১) বলাকা (১৯১৬), পুনশ্চ (১৯৩২), জন্মদিনে (১৯৪১), শেষলেখা (১৯৪১);
উপন্যাস : চোখের বালি (১৯০৩), গোরা (১৯১০), ঘরে-বাইরে (১৯১৬), শেষের কবিতা (১৯২৯);
ছোটগল্প :গল্পগুচ্ছ (১ম ও ২য় খন্ড-১৯২৬, ৩য় খন্ড-১৯২৭), তিনসঙ্গী (১৯৪১), গল্পসল্প (১৯৪১);
নাটক : বিসর্জন (১৮৯০), চিত্রাঙ্গদা (১৮৯২), অচলায়তন (১৯১২), ডাকঘর (১৯১২), রক্তকরবী (১৯২৬);
প্রবন্ধ : আধুনিক সাহিত্য (১৯০৭), কালান্তর (১৯৩৭), সাহিত্যের স্বরূপ (১৯৪৩); আত্মজীবনী : জীবন স্মৃতি (১৯১২), ছেলেবেলা (১৯৪০)।
ভূমিকা
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত ছোটগল্প ‘অপরিচিতা’ প্রথম প্রকাশিত হয় প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত মাসিক ‘সবুজপত্র’ পত্রিকার ১৩২১ বঙ্গাব্দের (১৯১৪) কার্তিক সংখ্যায়। এটি তৎকালীন উচ্চ সমাজের সংকীর্ণ মানসিকতা-বিষয়ক একটি গল্প।গল্পটি প্রথম গ্রন্থভুক্ত হয় রবীন্দ্র গল্পের সংকলন ‘গল্পসপ্তক’-এ এবং পরে ‘গল্পগুচ্ছ’ তৃতীয় খন্ড (১৯২৭)। যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে এটি একটি প্রতিবাদী গল্প। অন্যদিকে, গল্পকারএখানেনারীর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বকে তাঁর নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় ব্যাখ্যা করেছেন।
সাধারণ উদ্দেশ্য
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘অপরিচিতা’ গল্পটি পড়ার পর তুমি--
- রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে লিখতে পারবে।
- যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রতিরোধের কথা আন্তরিকভাবে উপলব্ধি করতে পারবে।
পাঠভিত্তিক উদ্দেশ্য
- এ পাঠ শেষে আপনিব্যক্তিত্বহীন অনুপমের চরিত্র বর্ণনা করতে পারবে।
- যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে শম্ভুনাথ বাবুর প্রতিরোধের চিত্র তুলে ধরতে পারবে।
মূলপাঠ
আজ আমার বয়স সাতাশ মাত্র। এ জীবনটা না দৈর্ঘ্যরে হিসাবে বড়, না গুণের হিসাবে। তবু ইহার একটু বিশেষ মূল্য আছে। ইহা সেই ফুলের মতো যাহার বুকের উপরে ভ্রমর আসিয়া বসিয়াছিল, এবং সেই পদক্ষেপের ইতিহাস তাহার জীবনের মাঝখানে ফলের মতো গুটি ধরিয়া উঠিয়াছে। সেই ইতিহাসটুকু আকারে ছোটো, তাহাকে ছোটো করিয়াই লিখিব। ছোটোকে যাঁহারা সামান্য বলিয়া ভুল করেন না তাঁহারা ইহার রস বুঝিবেন।
কলেজে যতগুলো পরীক্ষা পাস করিবার সব আমি চুকাইয়াছি। ছেলেবেলায় আমার সুন্দর চেহারা লইয়া পন্ডিতমশায় আমাকে শিমুল ফুল ও মাকাল ফলের সহিত তুলনা করিয়া, বিদ্রুপ করিবার সুযোগ পাইয়াছিলেন। ইহাতে তখন বড়ো লজ্জা পাইতাম; কিন্তু বয়স হইয়া এ কথা ভাবিয়াছি, যদি জন্মান্তর থাকে তবে আমার মুখে সুরূপ এবং পন্ডি তমশায়দের মুখে বিদ্রুপ আবার যেন অমনি করিয়াই প্রকাশ পায়।
আমার পিতা এক কালে গরিব ছিলেন। ওকালতি করিয়া তিনি প্রচুর টাকা রোজগার করিয়াছেন, ভোগ করিবার সময় নিমেষমাত্রও পান নাই। মৃত্যুতে তিনি যে হাঁফ ছাড়িলেন সেই তাঁর প্রথম অবকাশ। আমার তখন বয়স অল্প। মার হাতেই আমি মানুষ। মা গরিবের ঘরের মেয়ে; তাই, আমরা যে ধনী এ কথা তিনিও ভোলেন না, আমাকে ভুলিতে দেন না। শিশুকালে আমি কোলে কোলেই মানুষ- বোধ করি, সেইজন্য শেষ পর্যন্ত আমার পুরাপুরি বয়সই হইল না। আজও আমাকে দেখিলে মনে হইবে, আমি অন্নপূর্ণার কোলে গজাননের ছোটো ভাইটি।
আমার আসল অভিভাবক আমার মামা। তিনি আমার চেয়ে বড়োজোর বছর ছয়েক বড়। কিন্তু ফল্গুর বালির মতো তিনি আমাদের সমস্ত সংসারটাকে নিজের অন্তরের মধ্যে শুষিয়া লইয়াছেন। তাঁহাকে না খুঁড়িয়া এখানকার এক গন্ডুষও রস পাইবার জো নাই। এই কারণে কোনো-কিছুর জন্যই আমাকে কোনো ভাবনা ভাবিতেই হয় না। কন্যার পিতা মাত্রেই স্বীকার করিবেন, আমি সৎপাত্র। তামাকটুকু পর্যন্ত খাই না। ৎ
ভালোমানুষ হওয়ার কোনো ঝঞ্ঝাট নাই, তাই আমি নিতান্ত ভালোমানুষ। মাতার আদেশ মানিয়া চলিবার ক্ষমতা আমার আছে- বস্তুত, না মানিবার ক্ষমতা আমার নাই। অন্তঃপুরের শাসনে চলিবার মতো করিয়াই আমি প্রস্তুত হইয়াছি, যদি কোনো কন্যা স্বয়ম্বরা হন তবে এই সুলক্ষণটি স্মরণ রাখিবেন। অনেক বড়ো ঘর হইতে আমার সম্বন্ধ আসিয়াছিল। কিন্তু মামা, যিনি পৃথিবীতে আমার ভাগ্যদেবতার প্রধান এজেন্ট, বিবাহ সম্বন্ধে তাঁর একটা বিশেষ মত ছিল ধনীর কন্যা তাঁর পছন্দ নয়।
আমাদের ঘরে যে মেয়ে আসিবে সে মাথা হেঁট করিয়া আসিবে, এই তিনি চান। অথচ টাকার প্রতি আসক্তি তাঁর অস্থিমজ্জায় জড়িত। তিনি এমন বেহাই চান যাহার টাকা নাই অথচ যে টাকা দিতে কসুর করিবে না। যাহোক শোষণ করা চলিবে অথচ বাড়িতে আসিলে গুড়গুড়ির পরিবর্তে বাঁধা হুঁকায় তামাক দিলে যাহার নালিশ খাটিবে না। আমার বন্ধু হরিশ কানপুরে কাজ করে। সে ছুটিতে কলিকাতায় আসিয়া আমার মন উতলা করিয়া দিল। সে বলিল, “ওহে, মেয়ে যদি বল একটি খাসা মেয়ে আছে।”
কিছুদিন পূর্বেই এমএ পাস করিয়াছি। সামনে যত দূর পর্যন্ত দৃষ্টি চলে ছুটি ধূ ধূ করিতেছে; পরীক্ষা নাই, উমেদরি নাই, চাকরি নাই; নিজের বিষয় দেখিবার চিন্তাও নাই, শিক্ষাও নাই, ইচ্ছাও নাই- থাকিবার মধ্যেও ভিতরে আছেন মা এবং বাহিরে আছেন মামা। এই অবকাশের মরুভ‚মির মধ্যে আমার হৃদয় তখন বিশ্বব্যাপী নারীরূপের মরীচিকা দেখিতেছিল-আকাশে তাহার দৃষ্টি, বাতাসে তাহার নিঃশ্বাস, তরুমর্মরে তাহার গোপন কথা।
এমন সময় হরিশ আসিয়া বলিল, “মেয়ে যদি বল, তবে-”। আমার শরীর-মন বসন্তবাতাসে বকুলবনের নবপল্লবরাশির মতো কাঁপিতে কাঁপিতে আলোছায়া বুনিতে লগিল। হরিশ মানুষটা ছিল রসিক, রস দিয়া বর্ণনা করিবার শক্তি তাহার ছিল, আর আমার মন ছিল তৃষার্ত। আমি হরিশকে বলিলাম, “একবার মামার কাছে কথাটা পাড়িয়া দেখো।” হরিশ আসর জমাইতে অদ্বিতীয়। তাই সর্বত্রই তাহার খাতির। মামাও তাহাকে পাইলে ছাড়িতে চান না। কথাটা তাঁর বৈঠকে উঠিল। মেয়ের চেয়ে মেয়ের বাপের খবরটাই তাঁহার কাছে গুরুতর। বাপের অবস্থা তিনি যেমনটি চান তেমনি।
এক কালে ইহাদের বংশে লক্ষীর মঙ্গলঘট ভরা ছিল। এখন তাহা শূন্য বলিলেই হয়, অথচ তলায় সামান্য কিছু বাকি আছে। দেশে বংশমর্যাদা রাখিয়া চলা সহজ নয় বলিয়া ইনি পশ্চিমে গিয়া বাস করিতেছেন। সেখানে গরিব গৃহস্থের মতোই থাকেন। একটি মেয়ে ছাড়া তাঁর আর নাই। সুতরাং তাহারই পশ্চাতে লক্ষীর ঘটটি একেবারে উপুড় করিয়া দিতে দ্বিধা হইবে না। এসব ভালো কথা। কিন্তু, মেয়ের বয়স যে পনেরো, তাই শুনিয়া মামার মন ভার হইল। বংশে তো কোনো দোষ নাই?
না, দোষ নাই- বাপ কোথাও তাঁর মেয়ের যোগ্য বর খুঁজিয়া পান না। একে তো বরের হাট মহার্ঘ, তাহার পরে ধনুক-ভাঙা পণ, কাজেই বাপ কেবলই সবুর করিতেছেন- কিন্তু মেয়ের বয়স সবুর করিতেছে না। যাই হোক, হরিশের সরস রসনার গুণ আছে। মামার মন নরম হইল। বিবাহের ভ‚মিকা-অংশটা নির্বিঘ্নে সমাধা হইয়া গেল। কলিকাতার বাহিরে বাকি যে পৃথিবীটা আছে সমস্তটাকেই মামা আন্ডামান দ্বীপের অন্তর্গত বলিয়া জানেন। জীবনে একবার বিশেষ কাজে তিনি কোন্নগর পর্যন্ত গিয়েছিলেন।
মামা যদি মনু হইতেন তবে তিনি হাবড়ার পুল পার হওয়াটাকে তাঁহার সংহিতায় একেবারে নিষেধ করিয়া দিতেন। মনের মধ্যে ইচ্ছা ছিল, নিজের চোখে মেয়ে দেখিয়া আসিব। সাহস করিয়া প্রস্তাব করিতে পারিলাম না। কন্যাকে আশীর্বাদ করিবার জন্য যাহাকে পাঠানো হইল সে আমাদের বিনুদাদা, আমার পিস্ততো ভাই। তাহার মতো রুচি এবং দক্ষতার ’পরে আমি ষোলো-আনা নির্ভর করিতে পারি। বিনুদা ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, “মন্দ নয় হে! খাঁটি সোনা বটে!”
বিনুদাদার ভাষাটা অত্যন্ত আঁট। যেখানে আমরা বলি ‘চমৎকার’ সেখানে তিনি বলেন ‘চলনসই’। অতএব বুঝিলাম, আমার ভাগ্যে প্রজাপতির সঙ্গে পঞ্চশরের কোনো বিরোধ নাই। আসিবে, এই তিনি চান। অথচ টাকার প্রতি আসক্তি তাঁর অস্থিমজ্জায় জড়িত। তিনি এমন বেহাই চান যাহার টাকা নাই অথচ যে টাকা দিতে কসুর করিবে না। যাহোক শোষণ করা চলিবে অথচ বাড়িতে আসিলে গুড়গুড়ির পরিবর্তে বাঁধা হুঁকায় তামাক দিলে যাহার নালিশ খাটিবে না।
আমার বন্ধু হরিশ কানপুরে কাজ করে। সে ছুটিতে কলিকাতায় আসিয়া আমার মন উতলা করিয়া দিল। সে বলিল, “ওহে, মেয়ে যদি বল একটি খাসা মেয়ে আছে।” কিছুদিন পূর্বেই এমএ পাস করিয়াছি। সামনে যত দূর পর্যন্ত দৃষ্টি চলে ছুটি ধূ ধূ করিতেছে; পরীক্ষা নাই, উমেদরি নাই, চাকরি নাই; নিজের বিষয় দেখিবার চিন্তাও নাই, শিক্ষাও নাই, ইচ্ছাও নাই- থাকিবার মধ্যেও ভিতরে আছেন মা এবং বাহিরে আছেন মামা।
এই অবকাশের মরুভ‚মির মধ্যে আমার হৃদয় তখন বিশ্বব্যাপী নারীরূপের মরীচিকা দেখিতেছিলÑ আকাশে তাহার দৃষ্টি,বাতাসে তাহার নিঃশ্বাস, তরুমর্মরে তাহার গোপন কথা। এমন সময় হরিশ আসিয়া বলিল, “মেয়ে যদি বল, তবে-”। আমার শরীর-মন বসন্তবাতাসে বকুলবনের নবপল্লবরাশির মতো কাঁপিতে কাঁপিতে আলোছায়া বুনিতে লগিল। হরিশ মানুষটা ছিল রসিক, রস দিয়া বর্ণনা করিবার শক্তি তাহার ছিল, আর আমার মন ছিল তৃষার্ত।
আমি হরিশকে বলিলাম, “একবার মামার কাছে কথাটা পাড়িয়া দেখো।” হরিশ আসর জমাইতে অদ্বিতীয়। তাই সর্বত্রই তাহার খাতির। মামাও তাহাকে পাইলে ছাড়িতে চান না। কথাটা তাঁর বৈঠকে উঠিল। মেয়ের চেয়ে মেয়ের বাপের খবরটাই তাঁহার কাছে গুরুতর। বাপের অবস্থা তিনি যেমনটি চান তেমনি। এক কালে ইহাদের বংশে লক্ষীর মঙ্গলঘট ভরা ছিল। এখন তাহা শূন্য বলিলেই হয়, অথচ তলায় সামান্য কিছু বাকি আছে।
দেশে বংশমর্যাদা রাখিয়া চলা সহজ নয় বলিয়া ইনি পশ্চিমে গিয়া বাস করিতেছেন। সেখানে গরিব গৃহস্থের মতোই থাকেন। একটি মেয়ে ছাড়া তাঁর আর নাই। সুতরাং তাহারই পশ্চাতে লক্ষীর ঘটটি একেবারে উপুড় করিয়া দিতে দ্বিধা হইবে না। এসব ভালো কথা। কিন্তু, মেয়ের বয়স যে পনেরো, তাই শুনিয়া মামার মন ভার হইল। বংশে তো কোনো দোষ নাই? না, দোষ নাই- বাপ কোথাও তাঁর মেয়ের যোগ্য বর খুঁজিয়া পান না।
একে তো বরের হাট মহার্ঘ, তাহার পরে ধনুক-ভাঙা পণ, কাজেই বাপ কেবলই সবুর করিতেছেন- কিন্তু মেয়ের বয়স সবুর করিতেছে না। যাই হোক, হরিশের সরস রসনার গুণ আছে। মামার মন নরম হইল। বিবাহের ভ‚মিকা-অংশটা নির্বিঘ্নে সমাধা হইয়া গেল। কলিকাতার বাহিরে বাকি যে পৃথিবীটা আছে সমস্তটাকেই মামা আন্ডামান দ্বীপের অন্তর্গত বলিয়া জানেন। জীবনে একবার বিশেষ কাজে তিনি কোন্নগর পর্যন্ত গিয়েছিলেন। মামা যদি মনু হইতেন তবে তিনি হাবড়ার পুল পার হওয়াটাকে তাঁহার সংহিতায় একেবারে নিষেধ করিয়া দিতেন।
মনের মধ্যে ইচ্ছা ছিল, নিজের চোখে মেয়ে দেখিয়া আসিব। সাহস করিয়া প্রস্তাব করিতে পারিলাম না। কন্যাকে আশীর্বাদ করিবার জন্য যাহাকে পাঠানো হইল সে আমাদের বিনুদাদা, আমার পিস্ততো ভাই। তাহার মতো রুচি এবং দক্ষতার ’পরে আমি ষোলো-আনা নির্ভর করিতে পারি। বিনুদা ফিরিয়া আসিয়া বলিলেন, “মন্দ নয় হে! খাঁটি সোনা বটে!” বিনুদাদার ভাষাটা অত্যন্ত আঁট। যেখানে আমরা বলি ‘চমৎকার’ সেখানে তিনি বলেন ‘চলনসই’।
অতএব বুঝিলাম, আমার ভাগ্যে প্রজাপতির সঙ্গে পঞ্চশরের কোনো বিরোধ নাই। বলা বাহুল্য, বিবাহ-উপলক্ষে কন্যাপক্ষকেই কলিকাতায় আসিতে হইল। কন্যার পিতা শম্ভুনাথবাবু হরিশকে কত বিশ্বাস করেন তাহার প্রমাণ এই যে, বিবাহের তিন দিন পূর্বে তিনি আমাকে প্রথম চক্ষে দেখেন এবং আশীর্বাদ করিয়া যান। বয়স তাঁর চল্লিশের কিছু এপারে বা ওপারে। চুল কাঁচা, গোঁফে পাক ধরিতে আরম্ভ করিয়াছে মাত্র। সুপুরষ বটে। ভিড়ের মধ্যে দেখিলে সকলের আগে তাঁর উপরে চোখ পড়িবার মতো চেহারা।
আশা করি আমাকে দেখিয়া তিনি খুশি হইয়াছিলেন। বোঝা শক্ত, কেননা তিনি বড়ই চুপচাপ। যে দুটি-একটি কথা বলেন যেন তাহাতে পুরা জোর দিয়া বলেন না। মামার মুখ তখন অনর্গল ছুটিতেছিল- ধনে মানে আমাদের স্থান যে শহরের কারও চেয়ে কম নয়, সেইটেকেই তিনি নানা প্রসঙ্গে প্রচার করিতেছিলেন। শম্ভুনাথবাবু এ কথায় একেবারে যোগই দিলেন না- কোনো ফাঁকে একটা হুঁ বা হ্যাঁ কিছুই শোনা গেল না। আমি হইলে দমিয়া যাইতাম, কিন্তু মামাকে দমানো শক্ত।
তিনি শম্ভুনাথবাবুর চুপচাপ ভাব দেখিয়া ভাবিলেন, লোকটা নিতান্ত নির্জীব, একেবারে কোনো তেজ নাই। বেহাই-সম্প্রদায়ের আর যাই থাক, তেজ থাকাটা দোষের, অতএব মামা মনে মনে খুশি হইলেন। শম্ভুনাথবাবু যখন উঠিলেন তখন মামা সংক্ষেপে উপর হইতেই তাঁকে বিদায় করিলেন, গাড়িতে তুলিয়া দিতে গেলেন না। পণ সম্বন্ধে দুই পক্ষে পাকাপাকি কথা ঠিক হইয়া গিয়াছিল। মামা নিজেকে অসামান্য চতুর বলিয়াই অভিমান করিয়া থাকেন। কথাবার্তায় কোথাও তিনি কিছু ফাঁক রাখেন নাই।
টাকার অঙ্ক তো স্থির ছিলই, তারপরে গহনা কত ভরির এবং সোনা কত দরের হইবে সেও একেবারে বাঁধাবাঁধি হইয়া গিয়াছিল। আমি নিজে এসমস্ত কথার মধ্যে ছিলাম না; জানিতাম না দেনা-পাওনা কী স্থির হইল। মনে জানিতাম, এই স্থূল অংশটাও বিবাহের একটা প্রধান অংশ, এবং সে অংশের ভার যার উপরে তিনি এক কড়াও ঠকিবেন না। বস্তুত, আশ্চর্য পাকা লোক বলিয়া মামা আমাদের সমস্ত সংসারের প্রধান গর্বের সামগ্রী। যেখানে আমাদের কোনো সম্বন্ধ আছে সেখানে সর্বত্রই তিনি বুদ্ধির লড়াইয়ে জিতিবেন, এ একেবারে ধরা কথা, এই জন্য আমাদের অভাব না থাকিলেও এবং অন্য পক্ষের অভাব কঠিন হইলেও জিতিব, আমাদের সংসারের এই জেদ- ইহাতে যে বাঁচুক আর যে মরুক।
গায়ে-হলুদ অসম্ভব রকম ধুম করিয়া গেল। বাহক এত গেল যে তাহার আদমশুমারি করিতে হইলে কেরানি রাখিতে হয়। তাহাদিগকে বিদায় করিতে অপর পক্ষকে যে নাকাল হইতে হইবে, সেই কথা স্মরণ করিয়া মামার সঙ্গে মা একযোগে বিস্তর হাসিলেন। ব্যান্ড, বাঁশি, শখের কন্সর্ট প্রভৃতি যেখানে যতপ্রকার উচ্চ শব্দ আছে সমস্ত একসঙ্গে মিশাইয়া বর্বর কোলাহলের মত্ত হস্তী দ্বারা সংগীত সরস্বতীর পদ্মবন দলিত বিদলিত করিয়া আমি তো বিবাহ-বাড়িতে গিয়া উঠিলাম।
আংটিতে হারেতে জরিজহরাতে আমার শরীর যেন গহনার দোকান নিলামে চড়িয়াছে বলিয়া বোধ হইল। তাঁহাদের ভাবী জামাইয়ের মূল্য কত সেটা যেন কতক পরিমাণে সর্বাঙ্গে স্পষ্ট করিয়া লিখিয়া ভাবী শ্বশুরের সঙ্গে মোকাবিলা করিতে চলিয়াছিলাম। মামা বিবাহ-বাড়িতে ঢুকিয়া খুশি হইলেন না। একে তো উঠানটাতে বরযাত্রীদের জায়গা সংকুলান হওয়াই শক্ত, তাহার পরে সমস্ত আয়োজন নিতান্ত মধ্যম রকমের। ইহার পরে শম্ভুনাথবাবুর ব্যবহারটাও নেহাত ঠান্ডা। তাঁর বিনয়টা অজস্র নয়।
মুখে তো কথাই নাই কোমরে চাদর বাঁধা, গলা ভাঙা, টাক-পড়া, মিশ-কালো এবং বিপুল-শরীর তাঁর একটি উকিল-বন্ধু যদি নিয়ত হাত জোড় করিয়া মাথা হেলাইয়া, নম্রতার স্মিতহাস্যে ও গদগদ বচনে কন্সর্ট পার্টির করতাল-বাজিয়ে হইতে শুরু করিয়া বরকর্তাদের প্রত্যেককে বার বার প্রচুররূপে অভিষিক্ত করিয়া না দিতেন তবে গোড়াতেই এটা এস্পার-ওস্পার হইত। আমি সভায় বসিবার কিছুক্ষণ পরেই মামা শম্ভুনাথবাবুকে পাশের ঘরে ডাকিয়া লইয়া গেলেন।
কী কথা হইল জানি না, কিছুক্ষণ পরেই শম্ভুনাথবাবু আমাকে আসিয়া বলিলেন, “বাবাজি, একবার এই দিকে আসতে হচ্ছে।” ব্যাপারখানা এই। -সকলের না হউক, কিন্তু কোনো কোনো মানুষের জীবনের একটা কিছু লক্ষ্য থাকে। মামার একমাত্র লক্ষ্য ছিল, তিনি কোনোমতেই কারও কাছে ঠকিবেন না। তাঁর ভয় তাঁর বেহাই তাঁকে গহনায় ফাঁকি দিতে পারেন- বিবাহকার্য শেষ হইয়া গেলে সে ফাঁকির আর প্রতিকার চলিবে না।
বাড়িভাড়া সওগাদ লোক-বিদায় প্রভৃতি সম্বন্ধে যেরকম টানাটানির পরিচয় পাওয়া গেছে তাহাতে মামা ঠিক করিয়াছিলেন- দেওয়া-থোওয়া সম্বন্ধে এ লোকটির শুধু মুখের কথার উপর ভর করা চলিবে না। সেইজন্য বাড়ির স্যাকরাকে সুদ্ধ সঙ্গে আনিয়াছিলেন। পাশের ঘরে গিয়া দেখিলাম, মামা এক তক্তপোশে এবং স্যাক্রা তাহার দাঁড়িপাল্লা কষ্টিপাথর প্রভৃতি লইয়া মেজেয় বসিয়া আছে। শম্ভুনাথবাবু আমাকে বলিলেন, “তোমার মামা বলিতেছেন বিবাহের কাজ শুরু হইবার আগেই তিনি কনের সমস্ত গহনা যাচাই করিয়া দেখিবেন, ইহাতে তুমি কী বল।”
আমি মাথা হেঁট করিয়া চুপ করিয়া রহিলাম। মামা বলিলেন, “ও আবার কী বলিবে। আমি যা বলিব তাই হইবে।” শম্ভুনাথবাবু আমার দিকে চাহিয়া কহিলেন, “সেই কথা তবে ঠিক? উনি যা বলিবেন তাই হইবে? এ সম্বন্ধে তোমার কিছুই বলিবার নাই?” আমি একটু ঘাড়-নাড়ার ইঙ্গিতে জানাইলাম, এসব কথায় আমার সম্পূর্ণ অনধিকার। “আচ্ছা তবে বোসো, মেয়ের গা হইতে সমস্ত গহনা খুলিয়া আনিতেছি।” এই বলিয়া তিনি উঠিলেন। মামা বলিলেন, “অনুপম এখানে কী করিবে। ও সভায় গিয়া বসুক।”
শম্ভুনাথ বলিলেন, “না, সভায় নয়, এখানেই বসিতে হইবে।” কিছুক্ষণ পরে তিনি একখানা গামছায় বাঁধা গহনা আনিয়া তক্তপোশের উপর মেলিয়া ধরিলেন। সমস্তই তাঁহার পিতামহীদের আমলের গহনা- হাল ফ্যাশনের সূ² কাজ নয়- যেমন মোটা তেমনি ভারী। স্যাকরা গহনা হাতে তুলিয়া লইয়া বলিল, “এ আর দেখিব কী। ইহাতে খাদ নাই- এমন সোনা এখনকার দিনে ব্যবহারই হয় না।” এই বলিয়া সে মকরমুখা মোটা একখানা বালায় একটু চাপ দিয়া দেখাইল তাহা বাঁকিয়া যায়।
মামা তখনই নোটবইয়ে গহনাগুলির ফর্দ টুকিয়া লইলেন, পাছে যাহা দেখানো হইল তাহার কোনোটা কম পড়ে। হিসাব করিয়া দেখিলেন, গহনা যে পরিমাণ দিবার কথা এগুলি সংখ্যায় দরে এবং ভারে তার অনেক বেশি। গহনাগুলির মধ্যে একজোড়া এয়ারিং ছিল। শম্ভুনাথ সেইটে স্যাকরার হাতে দিয়া বলিলেন, “এইটে একবার পরখ করিয়া দেখো।” স্যাকরা কহিল, “ইহা বিলাতি মাল, ইহাতে সোনার ভাগ সামান্যই আছে।”
শম্ভুবাবু এয়ারিং জোড়া মামার হাতে দিয়া বলিলেন, “এটা আপনারাই রাখিয়া দিন।” মামা সেটা হাতে লইয়া দেখিলেন, এই এয়ারিং দিয়াই কন্যাকে তাঁহারা আশীর্বাদ করিয়াছিলেন। মামার মুখ লাল হইয়া উঠিল। দরিদ্র তাঁহাকে ঠকাইতে চাহিবে কিন্তু তিনি ঠকিবেন না এই আনন্দ-সম্ভোগ হইতে বঞ্চিত হইলেন এবং তাহার উপরেও কিছু উপরি-পাওনা জুটিল। অত্যন্ত মুখ ভার করিয়া বলিলেন, “অনুপম, যাও, তুমি সভায় গিয়ে বোসো গে।” শম্ভুনাথবাবু বলিলেন, “না, এখন সভায় বসিতে হইবে না। চলুন, আগে আপনাদের খাওয়াইয়া দিই।”
মামা বলিলেন, “সে কী কথা। লগ্ন-” শম্ভুনাথবাবু বলিলেন, “সেজন্য কিছু ভাবিবেন না- এখন উঠুন।” লোকটি নেহাত ভালোমানুষ-ধরনের, কিন্তু ভিতরে বেশ একটু জোর আছে বলিয়া বোধ হইল। মামাকে উঠিতে হইল। বরযাত্রীদেরও আহার হইয়া গেল। আয়োজনের আড়ম্বর ছিল না। কিন্তু রান্না ভালো এবং সমস্ত বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন বলিয়া সকলেরই তৃপ্তি হইল।
বরযাত্রীদের খাওয়া শেষ হইলে শম্ভুনাথবাবু আমাকে খাইতে বলিলেন। মামা বলিলেন, “সে কী কথা। বিবাহের পূর্বে বর খাইবে কেমন করিয়া।” এ সম্বন্ধে মামার কোনো মতপ্রকাশকে তিনি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করিয়া আমার দিকে চাহিয়া বলিলেন, “তুমি কী বল। বসিয়া যাইতে দোষ কিছু আছে?” মূর্তিমতী মাতৃ-আজ্ঞা-স্বরূপে মামা উপস্থিত, তাঁর বিরুদ্ধে চলা আমার পক্ষে অসম্ভব। আমি আহারে বসিতে পারিলাম না। তখন শম্ভুনাথবাবু মামাকে বলিলেন, “আপনাদিগকে অনেক কষ্ট দিয়াছি। আমরা ধনী নই, আপনাদের যোগ্য আয়োজন করিতে পারি নাই, ক্ষমা করিবেন। রাত হইয়া গেছে, আর আপনাদের কষ্ট বাড়াইতে ইচ্ছা করি না।
এখন তবে-” মামা বলিলেন, “তা, সভায় চলুন, আমরা তো প্রস্তুত আছি।”শম্ভুনাথ বলিলেন, “তবে আপনাদের গাড়ি বলিয়া দিই?” মামা আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “ঠাট্টা করিতেছেন নাকি।” শম্ভুনাথ কহিলেন, “ঠাট্টা তো আপনিই করিয়া সারিয়াছেন। ঠাট্টার সম্পর্কটাকে স্থায়ী করিবার ইচ্ছা আমার নাই।” মামা দুই চোখ এত বড়ো করিয়া মেলিয়া অবাক হইয়া রহিলেন। শম্ভুনাথ কহিলেন, “আমার কন্যার গহনা আমি চুরি করিব এ কথা যারা মনে করে তাদের হাতে আমি কন্যা দিতে পারি না।”
আমাকে একটি কথা বলাও তিনি আবশ্যক বোধ করিলেন না। কারণ, প্রমাণ হইয়া গেছে, আমি কেহই নই। তারপরে যা হইল সে আমি বলিতে ইচ্ছা করি না। ঝাড়লণ্ঠন ভাঙিয়া-চুরিয়া, জিনিসপত্র লন্ডভন্ড করিয়া, বরযাত্রের দল দক্ষযজ্ঞের পালা সারিয়া বাহির হইয়া গেল। বাড়ি ফিরিবার সময় ব্যান্ড রসনচৌকি ও কন্সর্ট একসঙ্গে বাজিল না এবং অভ্রের ঝাড়গুলো আকাশের তারার উপর আপনাদের কর্তব্যের বরাত দিয়া কোথায় যে মহানির্বাণ লাভ করিল সন্ধান পাওয়া গেল না।
শব্দের অর্থ ও টীকা
অন্তঃপুর- অন্দরমহল, ভেতরবাড়ি।
অন্নপূর্ণা-অন্নে পরিপূর্ণা, দেবী দুর্গা। অবকাশের মরুভ‚মি এক কালে ইহাদের বংশে
লক্ষৗর মঙ্গলঘট ভরা ছিল-লক্ষৗর ধন ও ঐশ্বর্যের দেবী। মঙ্গলঘট তাঁর প্রতীক। কল্যাণীদের বংশে একসময় লক্ষৗর কৃপায় ঐশ্বর্যের ঘট পূর্ণ ছিল।
অভিষিক্ত- অভিষেক করা হয়েছে এমন। ‘আজও আমাকে দেখিলে মনে হইবে, আমি অন্নপূর্ণার
কোলে গজাননের ছোটো ভাইটি।’- দেবী দুর্গার দুই পুত্র; অগ্রজ গণেশ ও অনুজ কার্তিকেয়। মা দুর্গার কোলে থাকা দেব- সেনাপতি কার্তিকেয়কে বোঝানো হয়েছে। ব্যঙ্গার্থে প্রয়োগ।
আন্ডামান দ্বীপ-ভারতীয় সীমানাভুক্ত বঙ্গোপসাগরের দ্বীপবিশেষ। স্বদেশী আন্দোলনের যুগে রাজবন্দিদের নির্বাসন শাস্তি দিয়ে আন্ডামান বা আন্দামানে পাঠানো হতো।
উমেদারি- প্রার্থনা, চাকরির আশায় অন্যের কাছে ধরনা দেওয়া। ‘এ জীবনটা না দৈর্ঘ্যরে হিসাবে বড়ো, না গুণের
হিসাবে’- গল্পের কথক চরিত্র অনুপমের আত্মসমালোচনা। পরিমাণ ও গুণ উভয় দিক দিয়েই যে তার জীবনটি নিতান্তই তুচ্ছ সে কথাই এখানে ব্যক্ত হয়েছে।
কষ্টিপাথর- যে পাথরে ঘষে সোনার খাঁটিত্ব যাচাই পরীক্ষা করা হয়।
কন্সর্ট- নানা রকম বাদ্যযন্ত্রের ঐকতান।
কোন্নগর- কলকাতার নিকটস্থ একটি স্থান।
গজানন- গজ আনন যার, গণেশ।
গন্ডষ - একমুখ বা এককোষ জল।
গুড়গুড়ি- আলবোলা, দীর্ঘ নলযুক্ত হুকাবিশেষ।
তরুমর্মর-গাছের শুকনা পাতার মরমর ধ্বনি।
দক্ষযজ্ঞা- প্রজাপতি দক্ষ কর্তৃক অনুষ্ঠিত যজ্ঞ। এ যজ্ঞে পতিনিন্দা শুনে সতী দেহত্যাগ করেন। স্ত্রীর মৃত্যুসংবাদ শুনে শিব অনুচরসহ যজ্ঞস্থলে পৌছে যজ্ঞ ধ্বংস করে দেন এবং সতীর শব কাঁধে তুলে নিয়ে প্রলয় নৃত্যে মত্ত হন। এখানে প্রলয়কান্ড বা হট্টগোল বোঝাচ্ছে।
দেওয়া-থোওয়া- বিয়ের যৌতুক ও আনুষঙ্গিক খরচ বোঝাতে কথাটি বলা হয়েছে।
পশ্চিমে- এখানে ভারতের পশ্চিম অঞ্চলকে বোঝানো হয়েছে।
পঞ্চশর-মদনদেবের ব্যবহার্য পাঁচ ধরনের বাণ।
প্রজাপতি- জীবের সষ্টা, ব্রহ্মা, বিয়ের দেবতা।
ফগুফল্গু- ভারতের গয়া অঞ্চলের অন্তঃসলিলা নদী। নদীটির ওপরের অংশে বালির আস্তরণ
কিন্তু ভেতরে জল স্রোত প্রবাহিত।
ফলের মতো গুটি- গুটি এক সময় পূর্ণ ফলে পরিণত হয়। কিন্তু গুটিই যদি ফলের মতোহয় তাহলে তার অসম্পূর্ণ সারবত্তা প্রকট হয়ে ওঠে। নিজের নিষ্ফল জীবনকে বোঝাতে অনুপমের ব্যবহৃত উপমা। ‘ফল্গু বালির মতো তিনি আমাদের সমস্ত সংসারটাকে নিজের অন্তরের মধ্যে শুষিয়া লইয়াছেন।’-
অনুপম তার মামার চরিত্র- বৈশিষ্ট্য প্রসঙ্গে কথাটি বলেছে। সংসারের সমস্ত দায়-দায়িত্ব পালনে তার ভূমিকা এখানে উপমার মাধ্যমে ব্যক্ত করা হয়েছে। ‘বর্বর কোলাহলের মত্ত হস্তী দ্বারা সংগীতসরস্বতীর পদ্মবন দলিত বিদলিত করিয়া আমি তো বিবাহ-বাড়িতে গিয়া
উঠিলাম’- অনুপম নিজের বিবাহযাত্রার পরিস্থিতি বর্ণনায় সুরশূন্য বিকট কোলাহলের সঙ্গে সংগীত সরস্বতীর পদ্মবন দলিত হওয়ার তুলনা করেছে।
বাঁধা হুঁকা- সাধারণ মানুষের ব্যবহার্য নারকেল-খোলে তৈরি ধূমপানের যন্ত্রবিশেষ।
বিদ্রুপ-পরিহাস, ঠাট্টা।
বিমর্ষ- বিষণ্ন, মনমরা।
মকরমুখো-মকর বা কুমিরের মুখের অনুরূপ।
মকরমুখো মোটা একখানা বালা- মকরের মুখাকৃতিযুক্ত হাতে পরিধেয় অলঙ্কারবিশেষ।
মনু- বিধানকর্তা বা শাস্ত্রপ্রণেতা মুনিবিশেষ।
মনু সংহিতা- মনুপ্রণীত মানুষের আচরণবিধি সংক্রান্ত গ্রন্থ।
মহানির্বাণ- সবরকমের বন্ধন থেকে মুক্তি।
মরীচিকা- বৃথা আশার ছলনা।
মহার্ঘ- মহামূল্যবান।
মাকাল ফল- দেখতে সুন্দর অথচ ভেতরে দুর্গন্ধ ও শাঁসযুক্ত খাওয়ার অনুপযোগী ফল। বিশেষ অর্থে গুণহীন।
লগ্ন- উপযুক্ত বা শুভ সময়।
লোক-বিদায়- পাওনা পরিশোধ।এখানে অনুষ্ঠানের শেষে পাওনাদারদের পাওনা পরিশোধের কথা বলা হয়েছে।
সওগাদ- উপঢৌকন, ভেট।
স্বয়ংবরা- যে মেয়ে নিজেই স্বামী নির্বাচন করে।
স্ফ‚লিঙ্গ- আগুনের ফুলকি বা কণা।
হিতৈষী- মঙ্গল করতে ইচ্ছুক।
অনির্বচনীয়- যাবর্ণনা করা যায় না, বর্ণনাতীত।
অভ্র- এক ধরনের খনিজ ধাতু।
অভ্রের ঝাড়-অভ্রের তৈরি ঝাড়বাতি।
একচক্ষু লণ্ঠন- একদিক খোলা তিনদিক ঢাকা বিশেষ ধরনের লণ্ঠন, যা রেলপথের সংকেত দেখানোর কাজে ব্যবহৃত হয়।
একপত্তন- একপ্রস্ত।
কলি- পুরাণে বর্ণিত শেষ যুগ, কলিযুগ, কলিকাল।
কলি যে চারপোয়া হইয়া আসিল!-কলিকাল পরিপূর্ণরূপে আত্মপ্রকাশ করল।
কানপুর- ভারতের একটি শহর।
ক্রোশ- এক ক্রোশ দুই মাইলের সমান।
‘গাড়ি লোহার মৃদঙ্গে তাল দিতে দিতে চলিল।- চলন্ত রেলগাড়ির অবিরাম ধাতব ধ্বনি বোঝানো হয়েছে।
জড়িমা- আড়ষ্টতা, জড়ত্ব।
‘তার পরে বুঝিলাম, মাতৃভ‚মি আছে।’- কল্যাণী যে দেশমাতৃকার সেবায় আত্মনিয়োগ করেছে, অনুপমের এই আত্মোপলব্ধি এখানে প্রকাশিত।
ধুয়া- গানের যে অংশ দোহাররা বারবার পরিবেশন করে।
পাকযন্ত্র- পাকস্থলী।
প্রদোষ- সন্ধ্যা।
মঞ্জরী- কিশলয়যুক্ত কচি ডাল, মুকুল।
মৃদঙ্গ- মাটির খোলের দুপাশে চামড়া লাগানো এক ধরনের বাদ্যযন্ত্র।
রসনচৌকি- সানাই,
ঢোল ও কাঁসি-এই তিন বাদ্যযন্ত্রে সৃষ্ট ঐকতানবাদন।
সারসংক্ষেপ
যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রতিরোধের গল্প ‘অপরিচিতা’-ব্যক্তিত্বহীন এক যুবক অনুপমেরজবানিতে লেখা। গল্পে বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী কল্যাণী ও তার পিতা শম্ভুনাথ সেনের চারিত্রিক দৃঢ়তার ফলেসমাজে গেড়ে বসা ঘৃণ্য যৌতুক প্রথা প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে। অনুপমের বয়স যখন অল্প, তার বাবা ওকালতি করে প্রচুরবিত্তের অধিকারী হয়েও ভোগ করার আগেই মারা যান। পিতৃহারা পুত্রকে তার মা এতটুকু কষ্ট করতে দেননি, ফলে
সাধারণ ঘরের ছেলেদের মতো অনুপমের মানসিক বয়োবৃদ্ধি ঘটেনি। তার মামাই এখন অভিভাবক হয়ে সমস্তসংসারটিকে কুক্ষিগত করেছেন। আর্থিক অবস্থা ভালো না হলেও শম্ভুনাথ বাবুর একমাত্র মেয়ে কল্যাণীর সঙ্গে অনুপমেরবিয়ের প্রস্তাব এলে তার মামা রাজী হয়ে যান। বিয়ের দিন মামা আকস্মিকভাবেই কন্যাপক্ষের দেওয়া সমস্ত গহনা যাচাই করতে চাইলে শম্ভুনাথ বাবু বিস্মিত ও মনঃক্ষুণ হন। তিনি কল্যাণীকে আর অনুপমের হাতে সমর্পণ না করেই অতিথিদেরযথারীতি আপ্যায়ন করিয়ে বিদায় দিলেন। বিয়েটা এভাবেই ভেঙে গেল।
বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১. কোন অঞ্চল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পলেখাকে প্রভাবিত করেছিল?
ক. কোন্নগর খ. শিলাইদহ
গ. কানপুর ঘ. জোড়াসাঁকো
২. স্বয়ংবরা বলতে বোঝায়
i. যে মেয়ে নিজে স্বামী নির্বাচন করে
ii. যে মেয়ের মামা স্বামী নির্বাচন করে
iii. যে মেয়ের পিতা স্বামী নির্বাচন করে
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i খ. ii
গ.iii ঘ. iiওiii
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং ৩ ও ৪ নং প্রশ্নের উত্তর দাও:
রবীন্দ্র ছোটগল্পকে এক দিক থেকে বাঙালির জীবনভাষ্য বলা চলে। তাঁর গল্পে একদিকে যেমন পুরুষতন্ত্রের অমানবিকতার স্ফুরণ ঘটেছে, তেমনি একইসঙ্গে পুরুষের ভাষ্যে নারীর প্রশস্তিও কীর্তিত হয়েছে।
৩. উদ্দীপকের বিষয়বস্তু কোন রচনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ?
ক. অপরিচিতা খ. আমার পথ
গ. বিলাসী ঘ. চাষার দুক্ষু
৪. উদ্দীপক ও ‘অপরিচিতা’ গল্পে মিল রয়েছে যে বিষয়ে-
i. বন্ধন থেকে মুক্তিতে
ii. পুরুষতন্ত্রের অমানবিকতায়
iii . নারীর প্রশস্তিতে
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i খ. ii
গ. iii ঘ. ii ও iii
৫. অনুপম মাকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছিল?
ক. তীর্থে খ. বিয়েবাড়িতে
গ. কন্সর্টে ঘ. রেলস্টেশনে
৬. অনুপমের মন ভরে যায় কেন?
ক. মধুর স্বরে খ. কর্কশ আচরণে
গ. জড়ানো ভঙ্গিতে ঘ. বাঁজখাই কথায়
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং ৭ ও ৮ নং প্রশ্নের উত্তর দাও :
ফাল্গুনি বিয়ে ভাঙার পর থেকে পথশিশুদের আলোকিত করার কাজ গ্রহণ করেছে। এটিতেই সে খুব আনন্দ উপভোগ করে।
৭. উদ্দীপকের বিষয়বস্তু ‘অপরিচিতা’ গল্পে কার চরিত্রে প্রতিফলিত হয়েছে?
ক. কল্যাণী খ. অনুপম
গ. হরিশ ঘ. বিনু
৮. উদ্দীপক ও ‘অপরিচিতা’ গল্পের চরিত্রে প্রকাশ পেয়েছেÑ
i. সাহসিকতা
ii. অভিমান
iii. আত্মমর্যাদা
নিচের কোনটি সঠিক?
ক. i খ. ii
গ. iii ঘ. i ও ii
৯. গজানন কে?
ক. কার্তিক খ. গণেশ
গ. ব্রহ্মা ঘ. প্রজাপতি
১০. কল্যাণী কেন বিয়ে করবে না?
ক. মামার নিষেধে খ. ব্যক্তিত্বের জাগরণে
গ. যৌতুকের কারণে ঘ. মাতৃ-আজ্ঞায়
নিচের উদ্দীপকটি পড় এবং ১১ ও ১২ নং প্রশ্নের উত্তর দাও :
আশুতোষ মুখার্জি উচ্চশিক্ষিত ও রুচিবান একজন মানুষ। তিনি কনের পিতা। বিয়ের অনুষ্ঠানে বরের মামা কনের
গহনা পরীক্ষা করতে চাইলে আশুতোষ বাবু ঠাÐা মাথায় তা করতে দেন।
১১. উদ্দীপকের সঙ্গে ‘অপরিচিতা’ গল্পের যে চরিত্রের মিল রয়েছেÑ
ক. গজানন খ. হরিশ
গ. শম্ভুনাথ ঘ. বিনু
১২. উদ্দীপক ও ‘অপরিচিতা’ গল্পের পিতা চরিত্রে মিল রয়েছে যে বিষয়েÑ
i. সৌজন্যবোধ
ii. সহনশীলতা
iii. নির্মমতা
নিচের কোনটি সঠিক?
ক.iও ii খ. ii
গ.iii ঘ. ii ও iii
উত্তরমালা: বহুনির্বাচনি প্রশ্ন
১. খ ২. ক ৩. ক ৪. ঘ ৫. ক ৬. ক ৭. ক ৮. গ ৯. খ ১০. ঘ ১১. গ ১২. ক
সৃজনশীল প্রশ্ন-১
এমনকি, কন্যার দর্শন সেও অতি সসংকোচে ভিক্ষা চাহিতে হয় এবং সময়বিশেষে নিরাশ হইলে দ্বিতীয় কথাটি কহিবার মুখথাকে না। কিন্তু মেয়ে আপনি বাড়ি আসিতে চাহিলে বাপ তাহাকে না আনিয়া কেমন করিয়া থাকে, তাই, বেহাইয়ের নিকট সে সম্বন্ধে দরখাস্ত পেশ করিবার পূর্বে রামসুন্দর কত হীনতা, কত অপমান, কত ক্ষতি স্বীকার করিয়া যে তিনটি হাজারটাকা সংগ্রহ করিয়াছিলেন, সে ইতিহাস গোপন থাকাই ভালো।
ক. অনুপমের বন্ধু হরিশ কোথায় কাজ করে?
খ. শম্ভুনাথ কন্যাকে পাত্রস্থ করলেন না কেন?
গ. উদ্দীপকের রামসুন্দরের সঙ্গে ‘অপরিচিতা’ গল্পের শম্ভুনাথ বাবুর অমিলগুলো তুলে ধর।
ঘ. “উদ্দীপকে লোকাচারকে মান্য করা হলেও ‘অপরিচিতা’ গল্পে তাকে অস্বীকার করা হয়েছে।” -মন্তব্যটি বিশ্লেষণ কর।
সৃজনশীল প্রশ্ন-১উত্তর
ক.
অনুপমের বন্ধু হরিশ কানপুরে কাজ করে।
খ.
বরপক্ষের নিচ মানসিকতার পরিচয় পেয়ে শম্ভুনাথ তার কন্যা কল্যাণীকে পাত্রস্থ করেননি।কল্যাণীর বিয়ের দিন পাত্রপক্ষ কনেপক্ষের উপহার দেয়া গহনাগুলো পরখ করার জন্য একজন সেকরাকে সঙ্গে করে নিয়েআসে। বর অনুপমের মামা সেকরাকে দিয়ে কল্যাণীর গহনাগুলো পরীক্ষা করান। এতে কল্যাণীর বাবা শম্ভুনাথ নিজেকেঅপমানিত বোধ করেন। আর এইসঙ্গে তিনি পাত্রপক্ষের নিচ মানসিকতারও পরিচয় পান।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পিতা শম্ভুনাথের মন ভেঙ্গে যায়। ফলে তিনি বিয়ের দিন কন্যাকে পাত্রস্থ না করে বরপক্ষকে ফিরিয়ে দেন।
গ.
আত্মমর্যাদার দিক থেকে উদ্দীপকের রামসুন্দর আর ‘অপরিচিতা’ গল্পে কনের পিতা শম্ভুনাথের অমিল রয়েছে।আমাদের সমাজে প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী কনের বাবা বিয়ের অধিকাংশ দায়িত্ব পালন করেন। বরপক্ষের খাবার-দাবার থেকে শুরু করে তাদের যতœ করা, মনরক্ষা ইত্যাদি কাজও তাকেই সামাল দিতে হয়। এছাড়া বিয়েতে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ ও জাতিবিশেষে নানা আচার এবং রুচির প্রয়োগে বৈচিত্র্য দেখা যায়। ফলে অনেক সময় কনের পিতাকে অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়।
উদ্দীপকে দেখা যায় রামসুন্দর মেয়ের বিয়ের পণের তিন হাজার টাকা অনেক ক্ষতি স্বীকার করে সংগ্রহ করেছেন। আর প্রচলিত লোকাচারের কারণে তিনি তার বেহাইয়ের নিকট অবনত। রামসুন্দর মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে বরপক্ষের অপমানকে নীরবে সহ্য করেছেন। অন্যদিকে ‘অপরিচিতা’ গল্পে কনের পিতা শম্ভুনাথ বাবু মেয়ের বিয়েতে যৌতুক দিতে সম্মত হয়েছেন। কিন্তু যখন বরপক্ষ গহনাগুলো যাচাই করার জন্য কল্যাণীর শরীর থেকে খুলে নিয়ে আসে তখন তিনি
অপমানিত বোধ করেন। তিনি মেয়ের বিয়ে ভেঙ্গে দেন। বরপক্ষের নিকট মাথা নত করেননি। এখানেই উদ্দীপকের রামসুন্দরের সঙ্গে ‘অপরিচিতা’ গল্পের শম্ভুনাথ বাবুর অমিল রয়েছে। বস্তুত বাংলাদেশের গত শতকের রক্ষণশীল, অনুদার ও যৌতুকের অভিশাপে জর্জরিত সমাজ ব্যবস্থা উভয় গল্পেরই পটভূমি।
ঘ
‘উদ্দীপকে লোকাচারকে মান্য করা হলেও ‘অপরিচিতা’ গল্পে তা অস্বীকার করা হয়েছে।’- মন্তব্যটি যথার্থ হয়েছে।যৌতুকপ্রথা আমাদের সমাজে একটি মারাত্মক ব্যাধি। পুরুষপ্রধান সমাজে যৌতুকপ্রথা নারীকে হেয় করে, অপদস্ত করে।এর ফলে কখনো কখনো নারীর জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠে। তবুও আমাদের সমাজে এমন কিছু মানুষ আছেন যারা এর বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করেন। তারা সমস্ত অন্তঃকরণ দিয়ে চান এই মরণ ব্যাধিকে নির্মূল করতে।
উদ্দীপকে একজন কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা রামসুন্দরের বর্ণনা রয়েছে। তার অনেক টাকা-পয়সা নেই। কন্যার বিয়েতে তাকে তিন হাজার টাকা পণ দিতে হয়েছে। এর জন্য তাকে অনেক অপমান, অনেক ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে। মেয়ের সুখের
জন্য তাকে বেহাইয়ের নিকট অবনত হতে হয়েছে। ‘অপরিচিতা’ গল্পেও দেখা যায়, পিতা শম্ভুনাথ মেয়ের বিয়েতে পণ দিয়েছেন। কিন্তু কল্যাণী তার একমাত্র মেয়ে বলেই তিনি পণ দিতে রাজি হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বরপক্ষের সংকীর্ণ
মানসিকতার পরিচয় পেয়ে বিয়েটি ভেঙ্গে দেন। এমনকি, কল্যাণীও প্রতিজ্ঞা করে যে, সে আর কোনোদিন বিয়ে করবেনা। উদ্দীপকে লোকাচারের বলয়ে একজন অসহায় পিতার চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। তিনি মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে সাহসী হয়ে উঠতে পারেননি। আর ‘অপরিচিতা’ গল্পে বাবা শম্ভুনাথ বাবু ও তার কন্যা কল্যাণী যৌতুকের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ
করেছে। বস্তুত উদ্দীপকে ফুটে উঠেছে যৌতুকপ্রথার নিষ্ঠুরতা ও ব্যক্তিজীবনে এর প্রভাব এবং ‘অপরিচিতা’ গল্পে প্রকাশিত হয়েছে যৌতুকপ্রথার বিরুদ্ধে একটি পরিবারের সুদৃঢ় অবস্থান। ওপরের আলোচনা শেষে তাই বলা যায়, উদ্দীপকে লোকাচারকে মান্য করা হলেও ‘অপরিচিতা’ গল্পে তাকে অস্বীকার করা হয়েছে।
নিজে কর
সৃজনশীল প্রশ্ন -২
কন্যার বাপ সবুর করিতে পারিতেন, কিন্তু বরের বাপ সবুর করিতে চাহিলেন না। তিনি দেখিলেন, মেয়েটির বিবাহের বয়সপার হইয়া গেছে, কিন্তু আর কিছুদিন গেলে সেটাকে ভদ্র বা অভদ্র কোনো রকমে চাপা দিবার সময়টাও পার হইয়া যাইবে।মেয়ের বয়স অবৈধ রকমে বাড়িয়া গেছে বটে, কিন্তু পণের টাকার আপেক্ষিক গুরুত্ব এখনো তাহার চেয়ে কিঞ্চিৎ উপরেআছে, সেইজন্যই তাড়া।
ক. কন্যাকে আশীর্বাদ করেছিলেন কে?
খ. অনুপম তার মামাকে ভাগ্যদেবতার প্রধান এজেন্ট বলেছে কেন?
গ. উদ্দীপকের কন্যা ‘অপরিচিতা’ গল্পের কোন চরিত্রের সঙ্গে সাদৃশ্যপূর্ণ? -আলোচনা করুন।
ঘ. “উদ্দীপকে যৌতুকের প্রতি লোভী মানসিকতা প্রকাশিত হয়েছে কিন্তু ‘অপরিচিতা’ গল্পে যৌতুকের বিরুদ্ধে পারিবারিক প্রতিরোধ পরিলক্ষিত হয়।” -মন্তব্যটি মূল্যায়ন করুন।
সৃজনশীল প্রশ্ন-৩
লিটন ও রুবির বিয়ে পাকাপোক্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিয়েতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে পাত্রপক্ষের সাধ্যাতীত যৌতুক দাবি। ফলে একসময় বিয়ে ভেঙ্গে যায়। অথচ রুবিকে লিটনের ভাল লাগে। পরবর্তী সময়ে লিটনের পরিবার বিয়েতে সম্মত হলেও রুবি তাতে অস্বীকৃতি জানায়। কিছুদিনের মধ্যে সে মেয়েদের পড়ানোর জন্য একটি স্কুল গড়ে তোলে। রুবি এখন দেশমাতৃকার সেবায় মগ্ন, বিয়ের স্বপ্ন সে আর দেখে না। স্কুলের মেয়েদের জীবন-স্বপ্নই এখন তার স্বপ্ন।
ক. কল্যাণীর সঙ্গে কয়টি মেয়ে ছিল?
খ. ‘ঠাট্টা তো আপনিই করিয়া সারিয়াছেন।’ - কথাটি কে কাকে এবং কোন প্রসঙ্গে বলেছে?
গ. উদ্দীপকের সঙ্গে ‘অপরিচিতা’ গল্পের কাদের মিল রয়েছে? - আলোচনা কর।
ঘ. “রুবি ও কল্যাণীর জীবন মূলত একই ধারায় প্রবাহিত হয়েছে।” - উদ্দীপকের আলোকে মন্তব্যটি মূল্যায়ন কর।
অর্ডিনেট আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url